টেক্সাস বা আইবেরিয়ান উপদ্বীপের মতো চীনের মধ্যাঞ্চলেও পুরোদমে চলছে এয়ার-কন্ডিশনার কনডেনসারগুলো। সম্প্রতি চীনের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ রেকর্ড পরিমাণে তাপমাত্রা সহ্য করেছেন কিংবা এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে গেছেন, যেখানে ৮০টির বেশি শহরে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সতর্কতা জারি করা হয়।
ঝেজিয়াং প্রদেশের পূর্বে একটি উৎপাদন কারখানাসহ বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরিতে লোড রেশনিং করা হয়। গত ১৩ জুলাই এই অঞ্চলে তামপাত্রা ৪২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল। আর্দ্রতার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো অনুভূত হয় বলে জানা যায়।
আগুনে তপ্ত হওয়ার মতো তাপমাত্রা গত বছরের জ্বালানি সংকটের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা চাহিদা মেটাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অনেক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে এবং কিছু পরিবার ব্ল্যাকআউটের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ এবার ঘাটতি এড়াতে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং চীনা সরকারের নিজস্ব উচ্চ কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে অশান্তি তো বটেই বাড়তি জটিলতা তৈরি করেছে।
চলতি বছরসহ উভয় ঘটনাই নিরাপদ জ্বালানির আকাঙ্ক্ষা ও জোরালো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ করছে। ফলে চীনের নেতারা বিভিন্ন মাত্রার ব্যবস্থা নিলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই অভিজ্ঞতা শিক্ষণীয় যে অন্যান্য দেশের সরকার জ্বালানি সংকট মোকাবিলার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে এতে বাজার ব্যবস্থায় প্রভাব পড়েছে।
গত বছর সরবরাহে বিঘ্ন, দুর্বল নীতির সঙ্গে এক দশকের মধ্যে চীনে বিদ্যুতের ঘাটতি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির দিকে যায়। কর্মকর্তারা জলবায়ু পরিবর্তন নীতির লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনেক কয়লা খনির উৎপাদন সীমিত করেছিল। (২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন যে ২০৩০ সালের আগে দেশের কার্বন নিঃসরণ সর্বনিম্ন হবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে চীন কার্বন নিরপেক্ষ হয়ে যাবে)।
তারপর কোভিড -১৯ মহামারির প্রাথমিক পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার জ্বালানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দাম বাড়তে দেওয়ার পরিবর্তে, রাজ্য পরিকল্পনাকারীরা বিদ্যুৎ ও কিছু কয়লার দামের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা বজায় রেখেছিল। পাওয়ার জেনারেটরগুলো অর্থ হারাতে শুরু করে এবং বেশ কিছু শেষ পর্যন্ত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অনেক খনি শ্রমিকও কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি শিল্প উৎপাদনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে।
এবার দেশটির অর্থনীতি শি জিনপিংয়ের ‘জিরো কোভিড’ নীতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ জুলাই প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, এক বছরের আগের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, বৈশ্বিক জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত তাপমাত্রা সরবরাহের পর্যাপ্ততা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে।
কর্মকর্তারা শরৎকালে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের আগে সেই শঙ্কা দূর করতে চাইছেন, যেখানে শি পার্টির নেতা হিসাবে তৃতীয় মেয়াদ নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তাদের অ্যাপ্রোচের মধ্যে রয়েছে সরবরাহ বৃদ্ধি, মজুত তৈরির প্রচেষ্টা, সেই সঙ্গে কিছু বাজার সংস্কার করা।
কয়লার কথাই ধরা যাক। চীনের ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লায়। বৈশ্বিক তাপ-কয়লার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, কারণ ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর তাদের নির্ভরতা হ্রাস করেছে। চীন এবার দেশীয় সরবরাহ বাড়াতে খনিতে উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। দেশটি রাশিয়ান কয়লাও লোড করছে, যা পশ্চিমারা এড়িয়ে যাচ্ছে। ব্লুমবার্গ বলছে, কর্মকর্তারা এমনকি অস্ট্রেলিয়ান কয়লা আমদানির ওপর দুই বছরের পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ারও বিবেচনা করছেন।
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন (এনডিআরসি), সরকারের পরিকল্পনা সংস্থা, বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে খনি শ্রমিকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি ও কমপক্ষে ১৫ দিনের মূল্যের কয়লা মজুত করার জন্য চাপ দিয়েছে।
চীন তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। প্রতিটি জ্বালানির প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ আমদানি করে থাকে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে উভয় পণ্যের বৈশ্বিক দাম বেড়েছে, যদিও সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা কমেছে।
অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজের মিশাল মেইডানের গবেষণা বলছে, চীনা আমদানিকারকরা ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল মজুত করেছে, যা আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার অধীনে। ফলে জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসের জন্য ব্যবস্থা হয়ে যায়।
পশ্চিমা ক্রেতারা পিছিয়ে পড়ায় চীনও রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড়ে আরও তেল কিনছে। গত মে মাসে রাশিয়া সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে।
চীনের প্রাকৃতিক-গ্যাস আমদানি মূলত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে আবদ্ধ ফলে এটি এখন পর্যন্ত দাম কমিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। কয়লার মতো পেট্রোল ও ডিজেলের অভ্যন্তরীণ দাম সীমাবদ্ধ রয়েছে। উচ্চ বৈশ্বিক অপরিশোধিত দাম মানে পরিশোধনকারীরা প্রায়ই অভ্যন্তরীণ বিক্রয়ে ক্ষতি করতে পারে। কঠোর রপ্তানি কোটা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধা দেয়। একজন পশ্চিমা তেল ব্যবসায়ী বলেছেন যে পরিকল্পনাকারীরা বিদেশে আরও কম বিক্রি করার জন্য রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থাগুলোর দিকে ঝুঁকেছে।
পরিশোধনকারীরা দাম বেশি হলে সরবরাহ কম করতে এবং পরিবর্তে অপরিশোধিত মজুত করতে উৎসাহিত করে। একটি রেটিং এজেন্সি এসএন্ডপি গ্লোবাল-এর ঝৌ জিঝো বলেছেন, ‘রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ হলো দেশে তেলের ঘাটতি থাকলে তেল রাখার একটি কৌশল।’
আপাতত কোনো ঘাটতি নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে সরকারের সরবরাহ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছে। ঘাটতি দূর করার একটি বড় কারণ হলো অর্থনীতির দুঃখজনক অবস্থা এবং এর সঙ্গে যুক্ত জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়া। কিছু অর্থনীতিবিদ ধারণা করেন যে, চীনের তেলের চাহিদা গত বছরের তুলনায় এ বছর ফ্ল্যাট বা আরও কম হতে পারে। আশাবাদী পূর্বাভাসকারীরা দেখতে পাচ্ছেন যে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রবৃদ্ধি মন্থর বা স্থবির হয়ে গেলেও বছরের শেষের দিকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। এটি বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম কমতে পারে ঠিক যেমন চীনকে আরও আমদানি করতে হবে।
যদি কারখানাগুলো প্রত্যাশিত সময়ের আগে আবার প্রাণ ফিরে পায়, তবে চীনের জ্বালানি নীতি একটি বাস্তব পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। খনি শ্রমিক, শোধনাগার ও পাওয়ার জেনারেটররা সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারেন দামের কারণে এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারেন। বিশেষ করে শীতকালে গ্যাসের ক্রেতাদের স্পট মার্কেটে যেতে বাধ্য করতে পারে, যেখানে দাম বেড়েছে। ফলে কর্মকর্তারা সেই তাপ আঁচ করতে শুরু করবেন।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট