আজাদের সংগৃহীত নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে প্রাচীনকালের তৈরি ৬টি পিতলের পাত্র। দেশ-বিদেশের মুদ্রা কয়েন দিয়ে সাজানো ধন ভাণ্ডারে বসানো হয়েছে প্লাস্টিকের সাপ। নামকরণ করা হয়েছে রত্নভাণ্ডার। পাশে রয়েছে দেড়শ বছরের পুরনো হাতির দাঁত ও সোয়া কেজি ওজনের সামদ্রিক ঝিনুক, ৫শ গ্রাম ওজনের কড়িসহ নানা প্রাচীন নিদর্শন। এছাড়া ১৬৭ দেশের নোট ও কয়েন, ছোট্ট কুরআন শরীফ, বিভিন্ন সময়ের স্বর্ণ, রৌপ্য ও ধাতব মুদ্রা এবং বিভিন্ন প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য। সোনার চামচ, রুপার গ্লাস, চাঁদির প্লেট ও মুকুট, পিতলের বিভিন্ন রকম প্রাচীন বাটি, সিঁদুরদানিসহ রয়েছে নানা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধাতব মুদ্রাসহ ১৭৬ দেশের মুদ্রা, ১৩০ বছর আগের কাঠের খড়ম, ১৭০ বছর আগের কাঠের ঢেঁকি, ১৯০ বছর আগের রুপার তৈরি কোমরের বিছাসহ প্রায় ২ হাজার প্রাচীন নিদর্শন।
নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্রের মধ্যে মাটির তৈজসপত্র, পিতলের কলস, মূর্তি, শামুক, পাটের জুতা পুরনো কাঠের খড়ম, কলের গান, অধুনালিপ্ত ঢেঁকি, লাঙ্গল ও লাঙ্গলের ইস, মাথাল, কাঁড়াল, মুগুর, খারুপঞ্চমী, হুক্কা প্রভৃতি রয়েছে। তাছাড়া দেশি ফল গাছের পাতা ও বিভিন্ন জাতের মাছ দিয়ে ৫০ আইটেমে লেখা ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধাবস্থার ম্যুরালও রয়েছে। কাঠে অংকন করা লালনসহ অনেক মনীষীর ছবিও আছে সংগ্রহশালায়।আবুল কালাম আজাদ তালুকদার জানান, প্রথমে গুরুদাসপুর তথা চলনবিল অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের নিমিত্তে নিজ বাড়িতে একটি কক্ষে এর যাত্রা শুরু হয়। নিদর্শনাবলীর সংগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আয়তন। ৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট প্রস্থের এই সংগ্রহশালার কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে আয়তন বাড়ানোর জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন তিনি। স্থানীয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যার কারণে সংগ্রহশালার কিছু নিদর্শন চুরি হওয়ায় আজাদ ওই প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন বন্ধ রেখেছিলেন। অনেকের উৎসাহে আবার তার কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
শাহজাদপুর সরকারি কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র আরফিন শুভ বলেন, ‘স্থানীয় লোকের মুখে শুনেই আমরা এখানে এসেছি। এখান থেকে অনেক কিছু দেখার ও জানার রয়েছে’।
সংগ্রাহক আবুল কালাম আজাদ তালুকদার জানালেন, ‘প্রায় ২৭ বছর ধরে এসব সংগ্রহ করছেন। শুরুর দিকে সংরক্ষণ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। রাখাও ছিল এলোমেলোভাবে। তার স্ত্রী জেসমীন সুলতানা এ কাজে দারুণভাবে সহযোগিতা করছেন’।
দেশ ও বিদেশের এসব উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলেও জানালেন আজাদ। তিনি এখনো সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ করতে কাজ করছেন। সংগ্রহশালাটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে সংগ্রহশালাটি।
আজাদ বলেন, ‘পেশাগত কারণে সময় দিতে পারি না। যেহেতু সংগ্রহশালাটি বাসায়, তাই প্রতিদিন খোলা রাখা সম্ভব হয় না। তবে শুক্রবার প্রায় ২০০ জন দর্শনার্থী আসেন’।
১৯৯৪ সাল। সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন আজাদ। অফুরন্ত সময়। সচ্ছল পরিবার। এক আত্মীয়র বাসায় ঘুরতে যান আজাদ। সেখানেই তিনি পান হাতির দাঁত যেটা তার আত্মীয় বাড়িতে বংশপরস্পরায় সংগ্রহে ছিল। তখন থেকেই তার মাথায় ঐতিহ্যবাহী নিদরর্শন সংগ্রহের পোকা ঢুকে। তখন থেকেই পরিচিত মানুষতো বটেই উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ শুরু করেন।
আজাদের বাবা আয়নাল হক তালুকদার বলেন, ‘আজাদের এসব দুর্লভ নিদর্শন সংগ্রহ দেখে প্রথম দিকে হেয়ালিপনা মনে হতো। আমরা সবাই তাকে পাগল বলতাম। অনেক টাকা খরচ করে এমন কাজ কে করে বলেন? তবে এখন আজাদের এই সংগ্রহশালা নিয়ে আমরা গর্ব করি’।
গুরুদাসুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন জানান, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার জন্য আমি আজাদকে ধন্যবাদ জানাই। কেননা এখন আর কেউ এরকম প্রাচীন সামগ্রী সংগ্রহ করে না। সংগ্রহশালাটি আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখবো’।