ঢাকায় রিকশা চালিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১৮ হাজার টাকার মতো আয় হয় ইউনুস আলীর। ভাগ্য ভালো হলে কোনো মাসে সেটা ১৯-২০ হাজারও হয়। নিম্নবিত্তের সংসার এই টাকায় মোটামুটি চলছিল বলা যায়। কিন্তু সম্প্রতি সংসারের খরচের খেই হারিয়েছেন তিনি। নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের ব্যয়বৃদ্ধি দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে তার। টাকার অভাবে গ্রামে পরিবারের কাছেও যাওয়া হচ্ছে না এখন।
জাগো নিউজকে তিনি জানান, কুড়িগ্রামে থাকা পরিবারের খরচ বেড়েছে কয়েক হাজার। ঢাকায় নিজের থাকা-খাওয়ায় গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। আগে মাসে একবার গ্রামের বাড়িতে যেতেন। ভাড়াসহ বাড়ি যাওয়ার পেছনে মোটামুটি দুই হাজার টাকার মতো খরচ হতো। সেই খরচও বেড়েছে দূরপাল্লার বাসভাড়া বেড়ে যাওয়ায়। অন্য কোনো খাতে খরচ কমানোর সম্ভব না হওয়ায় গ্রামে যাওয়া বন্ধ করেছেন তিনি।
অল্প শিক্ষিত হলেও হিসাব-নিকাশে পাকা ইউনুস। তিনি জানান, প্রতি মাসে তাকে গ্যারেজে থাকা ও দুই বেলা খাবারের জন্য দিতে হচ্ছে তিন হাজার ৪০০ টাকা। এরপর সকাল-বিকেলে নাশতা ও অন্যান্য হাতখরচ বাবদ খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকার বেশি। এরপর গ্রামে সাড়ে তিন হাজার টাকা কিস্তিসহ মোট সাড়ে ১১ হাজার টাকা পাঠাতে হয় তাকে। হাতে কোনো টাকা অবশিষ্ট থাকে না। আপদ-বিপদে পড়লে ধারদেনা করতে হয় প্রতি মাসেই। পরে সেটা সমন্বয় করতে খরচের টাকায় টান পড়ে। দিন দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কোনো হিসাব-নিকাশই মিলছে না তার।
ইউনুস আলী বলেন, ‘এত দিন টেনেটুনে সংসার খরচ চলতো। কিন্তু এখন হয় না। গ্রামেও বেশি টাকা দেওয়া যায় না, খরচ কাটছাঁট করতে হয়েছে। গত মাসে সঞ্চয় বন্ধ করেছি। আগে ঘর ওঠানোর জন্য কিছু ঋণ ছিল। এখন কিস্তি টানতে হচ্ছে ধারদেনা করে।’
তিনি বলেন, কিস্তির চিন্তায় ঘুম হয় না। সংসারই চলছে না, কিস্তি দেব কীভাবে? জীবনে এখন ভোগবিলাস বলে কিছু নেই। বেঁচে থাকাই বড় কথা।
ইউনুসের থেকে বেশি আয় করেন রামপুরার পণ্য বিপণনকারী কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সেলিম রহমান (ছদ্মনাম)। তবে তার বিপত্তি আরও বড়। রিকশাচালকের চেয়ে হাজার দশেক বেশি আয় করা সেলিম স্বপ্ন পূরণে ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করান সাধ্যের শেষ অবস্থানে গিয়ে। এখন সে খরচে টান পড়েছে তার।
সেলিম জানান, বড় ছেলে সরকারি আর ছোট মেয়েটা বেসরকারি স্কুলে পড়ছে। স্কুলের বেতন, বাসায় টিউশন, যাতায়াত ও টিফিন খরচ মিলিয়ে মাসে খরচ আট হাজার টাকা। সেটা বাদে আয়ের বাকি যায় বাসাভাড়া আর সংসার ব্যয় মেটাতে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ সময় আয়ের কিছুই হাতে থাকে না। কাপড়-চোপড়, চিকিৎসা বা বিনোদনের কিছু বেশি খরচ হলে ঋণ করতে হয়। এখন ব্যয় কমাতে গেলে নজর শুধু ওদের (সন্তানদের) খরচের দিকে।
বেশ কয়েক মাস ধরেই এ বেতনে কুলাতে পারছেন না তিনি। শেষ চলতি মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সংসারের খরচ অনেক কাটছাঁট করছেন বলে জানান। তারপরও হচ্ছে না জানিয়ে বলেন, ‘সকালে নাশতার বদলে ভাত খাচ্ছি। দুধ আর তেলের খরচ কমিয়েছে স্ত্রী। সন্তানদের ডিম-দুধ খাওয়া বন্ধ। স্কুলে যাওয়ার সময়ও নিয়মিত হাতখরচ দিতে পারছি না। গরুর মাংস বা বড় মাছ দিয়ে তরকারি রান্নার হয় না বেশ কিছুদিন। তারপরও হচ্ছে না।’
সেলিম বলেন, এখন ছোট মেয়েকে সরকারি স্কুলে আনবো। সেটাও আগামী বছর ছাড়া সম্ভব নয়। তাতে স্কুল ও টিউশনের খরচ হাজার দুয়েক কমবে।
শুধু ইউনুস আলী কিংবা সেলিমের গল্প এমন নয়। চলমান সময়ে অধিকাংশের আয় জীবন ধারণের জন্য অপ্রতুল। খারাপ পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষ। যেখানে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে তাদের নাজেহাল করে ফেলেছে। শেষ মাত্র একমাসের ব্যবধানে সংসারের বাজার খরচ বেড়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আয়ের চেয়ে দ্রুত ছুটছে মূল্যস্ফীতি, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ফলে এ সময় সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের খরচের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কাটছাঁট করছেন।
সংসারের হিসাব মিলছে না অনেক রিকশাচালকের-ফাইল ছবি
বর্তমানে বাজারের তথ্য বলছে, মাত্র এক মাসের মধ্যে চালের দাম বেড়েছে প্রায় কেজিপ্রতি ১৫ টাকা পর্যন্ত। বেড়েছে ডিম, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, রসুন, সবধরনের শাকসকজি এবং মাছ-মাংসের দাম। গরিবের তেলাপিয়া কিংবা এক কেজি পাঙ্গাশ মাছ কিনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা বেশি দামে। প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ টাকা। শাকের আঁটি ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি।
এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়ছে হুহু করে। একই সঙ্গে বেড়েছে সেবার মূল্য। অভ্যন্তরীণসহ দূরপাল্লার পরিবহন ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়েছে জ্বালানি তেলের কারণে। আবাসিকের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়তি গুনতে হচ্ছে কয়েক মাস ধরেই।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের ভূল পরিকল্পনার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। জ্বালানি তেলের অভূতপূর্ব উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এটা। এর আগেও গরিবের সংসারের খরচ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ানো হয়েছিল। গ্যাস ও বিদ্যুৎ দিয়ে। শেষ তেলের মূল্যবৃদ্ধি সে পরিস্থিতিকে আরেক দফা উসকে দিয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না নিম্ন আয়ের মানুষের-ফাইল ছবি
তিনি বলেন, এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উপস্থিতি নেই। এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, এখন তেলের দাম কমানো হলেও জিনিসপত্রের দাম কমবে না। কারণ সেটা তেলের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়েনি। সেই অজুহাতে মন মতো দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। যারা আবার সরকার ঘনিষ্ঠ। সময় এসেছে তাদের কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণের।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার যদি মনে করে মানুষের সহ্যসীমা পরীক্ষা করা শেষ হয়েছে। এখন এগুলো কমাতে পারি, তবে সেটা অবশ্যই সম্ভব।
অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ আরও গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। করোনার পর আবারো নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় পড়েছেন। ব্যয় সামাল দিতে অনেকে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মতো খাতে কাটছাঁট করছে।
দিন দিন জীবন কঠিন হয়ে পড়ছে শ্রমজীবী মানুষের-ফাইল ছবি
সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক নিবন্ধে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনা মহামারির প্রভাবে অনেক মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। তাদের স্বস্তি না দিয়ে উল্টো চাপ তৈরি করা হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে, যা সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি অস্থির করে তুলেছে।
সেজন্য মূল্যবৃদ্ধি পুনঃর্বিবেচনা করে এটি কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে সিপিডি। পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জন্য খোলাবাজারে কম দামে সরকারের পণ্য বিক্রি, রেশন কার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।