বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করে আসছে উন্নয়ন সহযোগী বিভ্ন্নি দেশ ও সংস্থা। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (স্বায়ত্তশাসিত ছাড়া)। বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত ঋণ-অনুদান সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের এসব ঋণ-অনুদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে। যার পরিমাণ প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
মোটা দাগে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশকে মোট সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ-অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ পর্যন্ত ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঋণ ছাড় করেছে ২১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ঋণ-অনুদান এসেছে এবং কমোডিটি (পণ্য) ঋণ এসেছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার পর এক উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এত পরিমাণে ঋণ-অনুদান কোনো উন্নয়ন সহযোগী দেয়নি, যা মোট ঋণ-অনুদানের ২৩ শতাংশ। গড়ে এখন বছরে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশকে চলমান ৫৫টি প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক এক হাজার ৫শ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আমি আপ্লুত। করোনাকাল থেকেই বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু আমি বিশ্বব্যাংকের বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকবো, সেহেতু আমার প্রতিটি বোর্ডসভায় ভূমিকা থাকবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কোনো বিষয় বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় উঠলে আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশকে ঋণ-অনুদান প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করে বিশ্বব্যাংক। প্রথমে বাংলাদেশকে মাত্র ১৬ দশমিক ৭৪ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে ৫ কোটি ডলার কমোডিটি ঋণ এবং ১১ দশমিক ৭ কোটি ডলার প্রকল্প ঋণ। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৬১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি বছর গড়ে ১২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে। একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ৩১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, প্রতি অর্থবছর গড়ে যা ৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।
বছরভিত্তিক ঋণ প্রতিশ্রুতির শীর্ষে বিশ্বব্যাংক
২০২০-২১ অর্থবছরে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি। এর পরই জাপান ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১ দশমিক ৬, এশিয়া অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ১ দশমিক ১ বিলিয়ন এবং ফ্রান্স ২৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে ২৮৫৪ কোটি টাকা ঋণ দিলো বিশ্বব্যাংক
বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহারের শীর্ষে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত
বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহারে বর্তমানে শীর্ষে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ৪৯টি প্রকল্পের আওতায় এই বিনিয়োগ ব্যবহার করছে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এ খাতে ৭১টি উন্নয়ন প্রকল্পে ২৪ হাজার ৮০২ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহার হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে ৫১ প্রকল্পে ৮ হাজার ৩২৮ কোটি ও হাউজিং অ্যান্ড কমিউনিটি ফ্যাসিলিটি খাতের ৩৮ প্রকল্পে ৬ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা ব্যবহার হচ্ছে। স্থানীয় সরকার এবং গ্রামীণ উন্নয়ন খাতের ২৭ প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে ৪ হাজার ৭৩ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ।
এছাড়া শিক্ষাখাতে ১৩ প্রকল্পে ১ হাজার ৮৩৯ কোটি, শিল্পখাতে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি, জেনারেল পাবলিক সার্ভিসে ১ হাজার ১২ কোটি, পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ৯৯৪ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহার করা হচ্ছে। মোটা দাগে ১০টি বড় খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ৮৭ হাজার ৩৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ ছাড়
প্রথমবারের মতো ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মেগা প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের যথাযথ ব্যবহার, উন্নয়ন ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা এবং কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের তহবিলের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ঋণ ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন এবং অনুদান ১৯৭ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগে বৈদেশিক সহায়তা সর্বোচ্চ অর্থছাড় হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে, ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে অর্থছাড় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে প্রায় ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ছিল বাজেট সহায়তা এবং টিকা কেনার ঋণ। বাকি অর্থ ব্যয় হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। কোভিডকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
সর্বোচ্চ অর্থছাড় করেছে এডিবি
২০২১-২২ অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ছাড় করেছে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। জাপান ছাড় করেছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
ছাড় হওয়া অর্থের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এসেছে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া রাশিয়া ১ দশমিক ২ বিলিয়ন এবং চীন ছাড় করেছে ১ বিলিয়ন ডলার।
কমেছে প্রতিশ্রুতি
২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় বাড়লেও তাদের প্রতিশ্রুতি কমেছে ১৩ শতাংশ।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান প্রত্যেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে চীনের কাছ থেকে।
পাইপলাইনে ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ এখন ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে সেই অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনে ছিল ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
টিকা কিনতে টাকা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক
করোনা ভ্যাকসিন কিনতে বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক একটি প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয়। এই অর্থায়নের মাধ্যমে ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে কোভিড-১৯ এর টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নেয় সরকার।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও বাংলাদেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। আগামীতে শিক্ষা ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে সংস্থাটির আরও অর্থায়ন চায় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। নানা উন্নয়ন প্রকল্পে সংস্থাটি আমাদের ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বেড়েছে। দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কথা বিবেচনা করেই বিদেশি বিনিয়োগে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।