একটু ভাবুন তো ২০২২ সালে এসে যদি আপনাকে দৈনিক ১২০ টাকা দিয়ে বলা হয়- আপনি এই টাকা দিয়ে সব মৌলিক চাহিদা মেটাবেন, তাহলে আপনাদের মনে কী চিন্তা আসবে! এই পরিমাণ টাকা দিয়ে কোনোভাবেই জীবন চালানো সম্ভব না, তাই তো। তবে আমাদের দেশে চা শ্রমিকদের এই ১২০ টাকা দিয়েই চলতে হয়। নানা বঞ্চনা নিয়ে দুর্দশার জীবন কাটায় তারা। এরকম দাসের মতো জীবন কাটালেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎপাদন ধরে রেখেছেন চা শ্রমিকরা৷ তাই জীবন সম্পর্কে শুধু আক্ষেপই ঝরে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের কণ্ঠে৷
আমাদের চা শ্রমিকের জীবন আধুনিক যুগেও যেনো আদি ও মধ্যযুগীয় দাসদের মতো। দাসদের মজুরি দেওয়া হতো না, চা শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় এটুকুই তফাৎ। কিন্তু খাটা-খাটুনিতে অথবা, অধিকারের প্রশ্নে চা শ্রমিকদের অবস্থা এই সময়ে সবচেয়ে করুণ। চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। অস্থায়ীভাবে কাজ করছে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ২০০৯ সালে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে বাগানের শ্রেণীভেদে শ্রমিকেরা যথাক্রমে দৈনিক ৪৮.৪৬ টাকা ও ৪৫ টাকা হারে মজুরি পান। স্থায়ী শ্রমিকদের রেশন হিসেবে প্রতিদিন আধা-কেজি চাউল অথবা আটা দেওয়া হয়। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী সর্বসাকুল্যে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক আয় ১২০ টাকা।
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও চা-বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকি, মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। চা-বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনো ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি। একরকম দাসের মতো জীবন কাটালেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎপাদন ধরে রেখেছেন চা শ্রমিকরা।
চা-শ্রমিকদের শ্রম-শোষণ করে চা বিদেশে রফতানি ও দেশে বিক্রি করে টাকার পাহাড় গড়ছেন চা-কোম্পানিগুলোর মালিকরা। এই স্বল্প পারিশ্রমিকে চা-শ্রমিকের পরিবারের লোকজনের কষ্টের জীবন কাটলেও তাদের শ্রম-শোষণকারী চা-কোম্পানি মালিকদের পরিবার বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাহিন হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, আমার বাড়ি সিলেটে। আমি খুব কাছ থেকে তাদের কষ্ট দেখেছি। বর্তমানে চা বাগানে শিশুশ্রম অনেকাংশে কমলেও শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ তেমন নেই৷ চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা থেকেও তারা অনেক পিছিয়ে। এভাবে একটা মানুষ চলতে পারে না। তাদের দাবি সরকারের মেনে নেওয়া উচিত।
রাজধানীর নিউ মার্কেটের চা বিক্রেতা শফিক মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ১২০ টাকায় এখন ২ কেজি চালও কিনতে পাওয়া যায় না। এক লিটার তেলের দামও ২০০ টাকার বেশি। এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। এই মজুরি তাদের সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছু না। আমি মনে করি তাদের দাবি ৩০০টাকা সরকার ও মালিক পক্ষের মেনে নেওয়া উচিত।
চা শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা আখতার রাইজিংবিডিকে বলেন, আমারা এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যে আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। সেখানে চা শ্রমিকদের ৩০০টাকা মজুরি দাবি যুক্তিযুক্ত মনে করছি। আমি তো অবাক হচ্ছি একটা মানুষ কি করে এই পরিমাণের টাকা দিয়ে চলতে পারে! এখন গ্রামের মাঠে ধান কাটার শ্রমিকদের মজুরি ৫০০ থেকে ৮০০০টাকা। এছাড়াও একজন গৃহকর্মীর বেতন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এই সময়ে এসে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ