জুয়েলের বাড়ি চাঁদপুরের দক্ষিণ মতলবে। স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে তিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জের আমিন আবাসিক এলাকায়। মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া। নারায়ণগঞ্জের দিগুবাবুর পাইকারি বাজারে সোনালি মুরগি ও হাঁস বিক্রি করেন। ২৩ দিন হলো ব্যবসা বন্ধ করে স্ত্রী-মেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আছেন। মাঝেমধ্যে এসে বাজার ঘুরে যাচ্ছেন, কিন্তু দোকান খুলছেন না।
জুয়েলের ভাষ্য, সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে। দেশি ও পাকিস্তানি মুরগির ক্রেতারা অপেক্ষাকৃত কম দামের ব্রয়লারের দিকে ঝুঁকছেন। যাঁরা ব্রয়লার খেতে পারেন না, তাঁরা উপলক্ষ ছাড়া মুরগি কিনছেন না। আর তাতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন তাঁর মতো ব্যবসায়ীরা। মুরগির দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘হাইব্রিড সোনালি মুরগির এক দিনের বাচ্চা ১২ টাকা থেকে দাম বেড়ে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি খাবারের দাম বেড়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। সেসব মুরগি বগুড়া থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে আসতে পরিবহন খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।’
জুয়েলের ভাষ্য, তিনি বগুড়া থেকে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে মুরগি কেনেন। প্রতি ট্রাকে ২ হাজার কেজি মুরগি আনতে খরচ হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে আসতে প্রতিটি মুরগির প্রায় ১০০ গ্রাম ওজন কমে। এতে মুরগির দাম বেড়ে যায় প্রতি কেজিতে আরও ৪০ টাকা। শহরের বাজারে লাভ গুনতে হলে তাঁকে মুরগি বিক্রি করতে হয় ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকায়। কিন্তু ক্রেতারা সেই দামে মুরগি কিনতে নারাজ। ফলে ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দিফিকির করে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকায় মুরগি বিক্রি করছেন।
সেই ফন্দিফিকির কেমন, জুয়েলের কাছে জানতে চাইলে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন না। তিনি কেবল বলেন, ‘এটা ব্যবসায়ীগো গোমর। তয় বলে রাখি, আপনেরা ৮০০ গ্রামের মুরগি কিনেন ১ কেজি হিসাবে।’ তবে এভাবে ব্যবসা করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জুয়েলের দাবি। এতে তাঁর পোষায় না। তার ওপর লোকজনের কথা শুনতে হয়। বাজার স্বাভাবিক হওয়ার আশায় আছেন তিনি।
জুয়েল বলেন, ‘এক লগে দুই হাজার মুরগি না আনলে পোষায় না। কিন্তু সোনালি মুরগির চাহিদা অর্ধেকে নাইমা আইছে। এত মুরগি এক লগে আনলে অর্ধেক যাইব মইরা। যারা সোনালি খাইত, তারা এহন ব্র্রয়লার খায়। বিয়াশাদি অইতাছে ব্রয়লার দিয়া। এরপর বাজারে আইয়া আমাগোরে গালিগালাজ করে। মাসখানেক আগে এক কাস্টমারের লগে তো কাইজ্জাই লাইগা গেছি। কয়, আমরা নাকি জুলুম করি। পরে কইলাম, আমিও আপনের মতো খাইয়া না খাইয়া থাহি। যেনে গালি দিলে কাম হইব, হেনে তো গালি দেন না।’
সেই ক্রেতার কথা ভেবে আক্ষেপও করেন জুয়েল। তিনি বলেন, ‘ওই লোকেরই দোষ কী? বাজারে গেলে মানুষের প্রেশার বাইড়া যায়। চাইল-ডাইল-নুন কিনার পর পকেটে টেকা না থাকলে মানুষ মুরগি কিনব কেমনে? একটার দাম বাড়লে চলে। সব জিনিষের দাম বাড়লে তহন মানুষের কায়দা কইরা বাঁচতে অয়। হেইডাই কইতেছিলাম ভাতিজারে।’
ভোর হলেই গ্রামে ফিরে যাবেন জুয়েল। জানালেন, শহরে খাবার খেতে প্রতিদিন ৩০০ টাকার বেশি খরচ হয়। ব্যবসা বন্ধ রেখে তাতে পোষায় না। ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে স্ত্রীর চিন্তা বেড়েছে। তাই তাঁকে জোর করে নারায়ণগঞ্জে পাঠিয়েছেন। সারা দিন বাজার ঘুরে তাঁর মন খারাপ আরও বেড়েছে। কৈশোর থেকে ব্যবসা শিখেছেন। পড়াশোনা হয়নি। অন্য কোনো কাজ জানেন না।
কথা শেষ না হতেই বসে থাকা কাঠের গুঁড়ি থেকে নিচে নেমে দাঁড়ান জুয়েল। বাসায় ফিরতে চান। যাওয়ার আগে তাঁর একটি ছবি তোলার অনুমতি চাইলে জুয়েল ইতস্তত বোধ করেন। শেষ পর্যন্ত ছবি তুলতে রাজি হন।