কোম্পানি গঠন করলেও বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী সেতুটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বিদেশি কোম্পানি দুটি থাকবে। তবে ভবিষ্যতে নিজেরা এই কাজ করবে—এমন ধারণা থেকে কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানির জনবল কাঠামো, কীভাবে কোম্পানি চলবে—এসব বিষয়ে কাজ চলছে। দ্রুত কোম্পানি গঠনের কাজ শেষ করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।’
পদ্মা সেতু দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এই টাকা ১ শতাংশ সুদে ঋণ হিসেবে দিয়েছে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়।
টোল থেকে আদায় করা আয় দিয়ে ৩৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য তিন মাস পরপর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৪০ কিস্তিতে ঋণের টাকা (সুদ ও আসল) পরিশোধ করা হবে।
পদ্মা সেতু চালুর পর ২৬ জুন প্রথম স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সেদিন সর্বোচ্চ ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন সেতু দিয়ে পারাপার হয়। ধীরে ধীরে সেতু দিয়ে যান চলাচল কমতে থাকে।
অবশ্য প্রথম দিন সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি ছিল। পরে সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। ঈদুল আজহার আগে-পরে এক সপ্তাহে সেতু থেকে দিনে ৭ কোটি টাকার বেশি আয় হয়।
বর্তমানে সেতুতে যানবাহন চলাচল দিনে গড়ে ১১ হাজারে নেমে এসেছে। আর আয় দাঁড়িয়েছে দিনে ২ কোটি টাকার মতো।
সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ২৬ জুন থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৬৪ দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে মোট ১০ লাখ ৮১ হাজার যানবাহন পারাপার হয়েছে। এই সময়ে দিনে গড়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ১৬ হাজার ৮৯৯টি।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নেওয়ার সময় যানবাহন চলাচলের বিষয়ে পূর্বাভাস তৈরি করেছিল জাপানি সংস্থা জাইকা। পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২২ সালে প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৯ সালে তা দাঁড়াবে ৩৪ হাজার ৭২৫টি। ২০৫০ সালে দিনে সেতু দিয়ে ৬৬ হাজার ৮২৯টি যানবাহন চলাচল করবে।
প্রথম ৬৪ দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে আয় হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। দিনে গড়ে আয় সোয়া ২ কোটি টাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এক বছরে ৬২১ কোটি টাকা আয় হবে।
পূর্বাভাসে সেতু দিয়ে প্রথম বছর আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, ৪৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, পূর্বাভাসের তুলনায় প্রথম বছরে ১৫৩ কোটি টাকা বেশি আয় হতে পারে।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পূর্বাভাসের চেয়ে এখন সেতু দিয়ে যানবাহন কম চলছে। তবে মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ দেওয়া হলে যানবাহনের সংখ্যা পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি হবে।
যানবাহন কম চলাচলের পরও আয় বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, পূর্বাভাসে ছোট যানবাহন বেশি চলবে বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাস, ট্রাকসহ বড় যানবাহন বেশি চলাচল করছে।
সূত্র বলছে, পূর্বাভাসের চেয়ে আয় বেশি হলেও এখনই সেতু থেকে মুনাফা হবে না। বরং লোকসান গুনতে হবে। কারণ, নিয়মানুযায়ী আদায় করা টোল থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে কেটে নেবে। ভ্যাট বাদে আয় থাকবে ৫২৮ কোটি টাকা। রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে বছরে দিতে হবে প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। আর হাতে থাকবে ৩৮৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করা চুক্তি অনুসারে, প্রথম বছর মন্ত্রণালয়কে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার কথা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মুনাফা দূরে থাক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিস্তির পুরো টাকাই শোধ করা যাবে না।
শুরুতে মুনাফা হবে না—এটা ধরেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ১৫ বছর পর যানবাহনের চলাচল বেড়ে গেলে, টোলের হার বাড়ানো হলে মুনাফা করতে শুরু করবে সেতু বিভাগ। ৩৫ বছরে এই সেতু থেকে আয় ধরা হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জাইকা ২০০৫ সালে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল ও আয়-ব্যয়ের হিসাব তৈরি করেছিল। ২০০৭ সালে প্রথমবার যে প্রকল্প নেওয়া হয়, তাতে সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এই ব্যয় আরও কিছুটা বাড়তে পারে বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছে।
সেতু বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যয় কম হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণের কিস্তি কমে যেত। এ জন্যই আপাতত মুনাফা করার সুযোগ থাকছে না।