রাজধানীর নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ইমাম হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মাত্র দেড় বছর পর ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গাজিরপাড় গ্রামে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন তিনি। পরে জানা যায় ইমাম হোসেনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় নিজের পরিবার বা বাবা-মায়ের কথা চিন্তা না করেই আত্মহত্যা করেন তিনি। এতে তাকে ঘিরে কৃষক বাবা তিলতিল করে যে স্বপ্ন গড়ে তুলছিলেন, তা যেন নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ইমাম হোসেনের অসহায় বাবা তোতা চৌকিদার।
ছেলের মৃত্যুর পর মানসিক অসুস্থতা ও দীর্ঘ সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তোতা চৌকিদার জাগো নিউজকে বলেন, ছেলে আত্মহত্যা করার ছয় মাস পর আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়েছি। আমার ছেলে অনেক মেধাবী ছিল। ছেলে কলেজে পড়ার জন্য ঢাকায় যাবে। তাই ভর্তি করে ঢাকায় বাসা নিয়ে আমিও তার সাথে থাকলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি এক মেয়ের সাথে নাকি সম্পর্ক আছে। সেটার কারণে হঠাৎ ছেলে আত্মহত্যা করলো। অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাইছি ছেলেটাকে। কিন্তু হঠাৎ করে সে মারা গেলো। নিজের পরিবার ও এলাকায় নাম করবো, কিন্তু তা না হয়ে উল্টাটা হইছে।
নারায়ণগঞ্জে জুলফিকার রড মিলে চাকরি করেন মো. আনোয়ার হোসেন। তিন মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের পলশিয়ায়। ২০২১ সালের মার্চ মাসে তিন মেয়ে রেখে আত্মহত্যা করেন আনোয়ারের স্ত্রী হাছিনা বেগম। এতে সামাজিকভাবে তো বটেই, তিন মেয়েকে নিয়ে আনোয়ার পারিবারিকভাবেও পড়েন বিপাকে। ১৭, ১৬ ও ৭ বছর বয়সী তিন মেয়েকে নিয়ে চলে তার মানসিক যন্ত্রণার জীবন।
স্ত্রী হাছিনা বেগমের মৃত্যুর পর নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরে আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। স্ত্রী মারা যাওয়ায় বেশি সমস্যা মেয়েদের। সবাই বলে মেয়ে তিনটার মা নেই। মা ছাড়া তিনটা মেয়ে নিয়ে সংসারে চলা বেশ কঠিন। মেয়েদের বাড়িতে আমার মায়ের কাছে রেখে আমাকে চলে আসতে হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। বর্তমান সময়ে মেয়েদের এভাবে রেখে আসার পর সবসময়ই একটা চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়।’
শুধু এসব ঘটনাই নয়, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ফেসবুক লাইভে এসে হতাশা ও দুঃখের কথা তুলে ধরে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান, যা হতবাক করে পুরো জাতিকে।
বছরে ৯০৯৯ জনের আত্মহনন, প্রবণতা কিশোর-তরুণদের বেশি
মনোবিদদের মতে, জীবনকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা, বেঁচে থাকা অর্থহীন, বিষণ্নতাসহ নানা নেতিবাচক ভাবনা মানুষকে আত্মহননের পথে তাড়িত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে ছয়জন আত্মহত্যা করে। সাম্প্রতিক জনশুমারির (১৬ কোটি ৫১ লাখ) হিসাবে বছরে ৯ হাজার ৯০৯ জন আত্মহত্যা করে। এই আত্মহত্যার হার বেশি ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী কিশোর ও তরুণদের মধ্যে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য মতে, দেশে বছরে এখন গড়ে ১০ হাজার জন আত্মহত্যা করে। কোভিডকালে এটি বেড়ে প্রায় ১৪ হাজার হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০২০ সালের জরিপে প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন হারে ১৩ হাজার ৮১৪ জন আত্মহত্যা করে। সে সময় দেশের মোট জনসংখ্যা ধরা হয় ১৭ কোটি ১৬ লাখ। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের গড় প্রায় সমান। ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এতে বছরে আত্মহত্যাকারীর পরিবার ও আত্মীয় মিলে আত্মহত্যার ঘটনার পর এক লাখের বেশি মানুষ মানসিক চাপে পড়ে। এছাড়া সম্মানহানিসহ সামাজিক নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের। কেবল আত্মহত্যার কারণেই এ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। সেই সঙ্গে থাকে সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতি।
বিশ্বের অনেক দেশ আত্মঘাতকদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার আইনি বৈধতা নেই। তাই আত্মহত্যা এখানে অপরাধ। শুধু আইনই নয়, ধর্মীয় দিক থেকেও এটি মহাপাপ ও অপরাধ।
একজনের আত্মহননের গ্লানি টানতে হয় পরিবারকে
এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সমাজে যখন প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়, মানুষের মনে চাপ বাড়ে, জীবন ধারণের চাপ বাড়ে তখন আত্মহত্যা করে। কিন্তু আত্মহত্যাটা এক ধরনের অপরাধ। কারণ একটা জীবনকে শেষ করে দেওয়া আমাদের দেশের সমাজ ও আইন সেটাকে বৈধতা দেয়নি। আত্মহনন করলে পরিবার ও সমাজে একটি বিরূপ প্রভাব পড়ে। এতে সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। মানসিক যে চাপ তা নিয়েই সেই পরিবারের মানুষদের চলতে হয়। শুধু তাই নয়, পরিবারটিকে নিয়ে সমাজেও এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটা পরিবারের কলঙ্ক, তা নিয়ে বাঁচতে হয়, চলতে হয়।
পরিবারের কোনো সদস্যের আত্মহত্যার ফলে মানসিক চাপের পাশাপাশি সমাজে একটি পরিবারকে নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই সময়ে পরিবারের সমস্যার কথা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমেই পরিবারটি বিরাট ক্ষতিতে পড়ে। এমন একটি ঘটনার মাধ্যমে যায় যে পরিবারটি সামাজিকভাবে অনুধাবন করে। মানুষজন তাকে অন্যভাবে দেখতে পারে। এ ব্যাপারগুলোর মুখোমুখি তাদের হতে হয়। তাদের কষ্টের জায়গাটা তো আছেই সেই সাথে মানসিকভাবে তারা অনেকটা চাপে থাকে। এটা কেন করেননি, সঠিক শিক্ষা দেননি, একেক মানুষ একেক ধরনের কথা বলতে থাকে এবং কে কী বলবে সেটাও পরিবারটি আন্দাজ করতে পারে। মানুষও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পরিবারটির আশপাশে যারা থাকে তারা সেটা বোঝার চেষ্টা করে না। নানা কৌতূহল থাকে জানার। অথচ তাদের যে কষ্টটা সেটা কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। এটা থেকে বিরত থাকা উচিত।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আত্মহত্যা জীবনে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়’। তাই আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে পরিবার ও সমাজের দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আত্মহনন রোধে করণীয়
আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরে অধ্যাপক জিয়া বলেন, পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যেন সংগ্রাম করতে না হয়। পারিবারিক বন্ধনটা যেন থাকে। কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। সামাজিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না। খেলাধুলা, সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে সম্পৃক্ত থাকা, সৃজনশীল কাজে যত বেশি যুক্ত হওয়া যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। কোনো কাজ করতেই হবে বা একটা জিনিস পেতেই হবে এটা নয়।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশে আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে সামাজিকভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মেহজাবিন হক জাগো নিউজকে বলেন, সঠিক চিকিৎসা করা জরুরি। সেই সঙ্গে যারা আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতিতে চলে যায় তার কথাগুলো শোনা এবং তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা ও ভালো কাজে উৎসাহিত করা। মানুষের জীবন অমূল্য তাই একে বিনাশ করা উচিত নয়।
মানসিক রোগীদের ৯৫ শতাংশই চিকিৎসা পান না, এমন রোগীদের চিকিৎসা দরকার
মানুষের আত্মহত্যার নানামাত্রিক কারণ থাকে। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষের পাশে সমাজ ও পরিবারকে সবসময় থাকা জরুরি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এসব মানুষের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। চিকিৎসা নিতে আসা অধিকাংশ মানসিক রোগী সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামাল জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ বুঝেই না তার পরিবারের বা পাশের মানুষটি গভীর বিষণ্নতায় রয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া উচিত। চিকিৎসা নিতেই আসে না। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছি মোট মানসিক রোগীর ৯৫ শতাংশ চিকিৎসা পায় না। সামাজিক অজ্ঞতা, অসচেতনতার কারণে তারা এই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ যারা চিকিৎসা নিতে আসে তাদের প্রায় সবাই সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ফিরে যায়। তাই আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়াটা জরুরি।
ডা. এম এ মোহিত কামাল বলেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পরিবারের মানুষকে সচেতন করতে হবে সবার আগে। এর পাশাপাশি বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, সহকর্মী কিংবা আশপাশের মানুষটিকে সচেতন হতে হবে। তবেই আত্মহত্যার সংখ্যা কমে আসবে।