# ২০২০ সালে পরচুলার বিশ্ববাজার ছিল ৫৭৭ কোটি ডলার
# বিগত ১০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণ
# ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার সাড়ে ৬৫ শতাংশ বেশি
# বাংলাদেশের তৈরি পরচুলা যাচ্ছে বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে
বাড়িতে মা-বোনদের আঁচড়ানোর পর ওঠা চুল কিংবা সেলুনের চুলও এখন ফেলনা নয়। একশ্রেণির ফেরিওয়ালা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এসব চুল সংগ্রহ করেন। ফেলনা এই চুলের দামও একেবারে কম নয়। কয়েক হাত বদল করে সেই চুল যায় কারখানায়। তৈরি হয় পরচুলা। যার গন্তব্য দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা। খুব বেশি না হলেও প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা আনছে এই ফেলনা চুল। বাড়ছে কর্মসংস্থান। গ্রামীণ নারীদের বড় একটি অংশ যুক্ত এ কাজে। মাসে ৮ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন তারা। বাংলাদেশে আসছে কোটি কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর কয়েকজন উদ্যোক্তা এই ব্যবসা শুরু করেন। তবে দুই দশকে তা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সম্ভাবনা দেখে এ খাতে আসে বিদেশি উদ্যোগ। লক্ষাধিক মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আট বছর আগেও উইগ বা পরচুলা রপ্তানি করে কোটি ডলার অর্জন ছিল স্বপ্নের মতো। তবে এই চিত্র বদলেছে। সামনে দেখা দিচ্ছে আরও সম্ভাবনা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, অপ্রচলিত এই পণ্যটি রপ্তানি করে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা আসে ২০১৫ -১৬ অর্থবছরে। ওই সময় পরচুলা রপ্তানি করে ১ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেন উদ্যোক্তারা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরচুলা রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩ কোটি ২৫ লাখ ডলার হয়। করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে পরচুলা রপ্তানি এক লাফে বেড়ে ৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা পৌঁছায় ১০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ছিল প্রায় সাড়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। ১০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন- চীন, কোরিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে উইগ বা পরচুলার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন অসুস্থাজনিত কারণে যাদের মাথার চুল পড়ে যায় তারাসহ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ উইগের বড় ক্রেতা। হ্যালোইন, ক্লাউন, ক্যারিবিয়ান প্যারেড, সাম্বা ড্যান্সসহ বিভিন্ন উৎসবে যায় বাংলাদেশের পরচুলা।
সাভারের আরিফ মাহমুদ নামে এক উদ্যোক্তা জাগো নিউজকে বলেন, কারখানাগুলোতে পরচুলাসহ নানান পণ্য উৎপাদন করা হয়। একটি ছোট পরচুলা তৈরি করতে সময় লাগে দুই থেকে চারদিন। মানুষের চুল সংগ্রহ করে চীন, কোরিয়া সিনথেটিক ফাইবার এনে পরচুলার ক্যাপ তৈরি করা হয়। এসব ক্যাপ রপ্তানি করা হয় বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে।
তিনি বলেন, করোনায় চীনের অনেক পরচুলা কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের অর্ডার বেড়েছে। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাবে আমরা অনেক বড় বাজার ধরতে পারছি না। সরকারের সুনজর ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে এ খাতে ব্যাপক রপ্তানি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বড় কারখানার পাশাপাশি কিছু ছোট কারখানাও গড়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব কারখানা বড় কারখানাকে সাপ্লাই করে। গফরগাঁও পাচুয়ার সাবের খাঁ বাড়িতে নারী জাগরণের ব্যানারে প্রায় ৩০০-৪০০ নারী পরচুলা তৈরির কাজ করেন। সেখানে নানা ধরনের পরচুলা তৈরি হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছোট চুলের ক্যাপ। বাংলাদেশে এই ক্যাপের চাহিদা অনেক। সাধারণত যেসব ছেলের মাথায় চুল নেই তারা এটা ব্যবহার করেন। ছোট চুলের ক্যাপের চাহিদা ভারতেও বাড়ছে।
পরচুলা দিয়ে সাইড স্কালও তৈরি হয়। সাধারণত যেসব পুরুষের মাথায় চুল নেই তারা সাইড স্কাল ব্যবহার করেন। এই পরচুলার চাহিদা অস্ট্রেলিয়ায় বেশি। এখানে মনোক্যাপও তৈরি করছেন নারীরা। যেসব পুরুষের পেছনে চুল আছে কিন্তু সামনে নেই তারা মনোক্যাপ ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ ও ভারতে এই পরচুলার চাহিদা তুঙ্গে।
গফরগাঁও আলতাফ গোলন্দাজ ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী স্বর্ণা আক্তার। পরচুলার কাজ করে তিনি মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে পরচুলা শিল্পে নিয়োজিত রেখেছেন।
পরচুলা কারিগর স্বর্ণা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, গত ৭ থেকে ৮ বছর পরচুলা শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছি। তবে পরিচালনার কাজে জড়িত গত এক বছর। লেখাপড়া করছি, পাশাপাশি দায়িত্বও পালন করছি। আমি এখন লিডার। সেই হিসেবে ১৫ হাজার টাকা পাই। এছাড়া হাতে কাজও করি। সব মিলিয়ে ২০-২২ হাজার টাকা আয় করতে পারি।
ডাবলিনভিত্তিক বাজার বিশ্নেষণ সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের তথ্যমতে, ২০২০ সালে পরচুলার বিশ্ববাজার ছিল ৫৭৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে পরচুলা রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ হেয়ার প্রোডাক্টস প্রসেসরস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, পরচুলা রপ্তানিতে আমরা প্রতি বছর ভালো করছি। ইপিজেডগুলোতে বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন। ২০টির বেশি ফ্যাক্টরি আছে চায়নিজ, হংকং, কোরিয়ানদের। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।
জানা যায়, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় চুল বেচাকেনা হয়। প্রক্রিয়াজাত চুল ও চুলের টুপি বা উইগ দুইভাবে রপ্তানি হয়। এক সময় শুধু বিদেশে রপ্তানি হলেও এখন দেশেও পরচুলার কদর বেড়েছে।
উদ্যোক্তারা জানান, ফেরিওয়ালারা বাসাবাড়ির মা-খালাদের কাছ থেকে প্লাস্টিক পণ্য, খেলনা কিংবা খাবারের বিনিময়ে সংগ্রহ করেন চুল। গুচ্ছপ্রতি চুল সংগ্রহ করতে ফেরিওয়ালাদের ১০ থেকে ২০ টাকা খরচ হয়। প্রতি কেজি চুল বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রক্রিয়াজাতকরণে আসে। প্রতি কেজি চুল সংগ্রহ করতে কারখানাগুলোর খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
মিরপুরের মারিলিন হেয়ার ড্রেসারের কর্মচারী শরিফুল মুক্তার বলেন, আগে ব্যাগভর্তি চুল ডাস্টবিনে ফেলে আসতাম। এখন বিক্রি হয়। প্রতি ব্যাগ চুল ১০০ টাকা দেয়। মাথায় চুল না থাকা বা কম থাকা ব্যক্তিরা পরচুলা ব্যবহার করেন। আবার অনেকেই লুক চেঞ্জ করার জন্যও পরচুলা কেনেন। এছাড়া বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, নাটক-সিনেমার শুটিংয়ে পরচুলা ব্যবহার হচ্ছে।
আবুল কালাম বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় উইগ কারখানার একটি বাংলাদেশে আছে। চারটি বড় পরচুলা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে এখানে। উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস। যেখানে প্রায় ৩৬ হাজার কর্মী কাজ করে। ঈশ্বরদীতে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড ও মোংলায় আছে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি। ইপিজেডগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)।
জানতে চাইলে বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর বলেন, পরচুলা সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠতে পারে। দিন দিন রপ্তানিও বাড়ছে। বড় কোনো বাধা না পেলে এ খাত থেকে আয় দেড় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।