করোনা সংকট, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে দিশেহারা মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। সবমিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। এ অবস্থায় ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে বিশ্বের অনেক দেশ।
বেশ কিছুদিন ধরেই এ ধরনের আভাস দিয়ে আসছিল বিশ্বব্যাংক। সবশেষ গত ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সাধারণ সভায় সেই আশঙ্কাকেই আরও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বলছে, বৈশ্বিক এ মন্দার কবলে পড়লে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্যসংকটে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার টেকসই অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আসছে বরাবরই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও বেশ কয়েকবছর ধরে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক ক্রমবর্ধমান মন্দায় খাদ্য সরবরাহ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আবার পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্য মানুষ কতটা পাচ্ছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে। খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে অনেক পরিবারে আমিষে টান পড়েছে। অনেকের কাছে এখন পুষ্টিকর খাবার হয়ে উঠছে দুষ্প্রাপ্য।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যে একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি সেটা প্রাধানমন্ত্রীও বলেছেন। আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা কিন্তু অমূলক নয়। সেটা কোন দেশে কতটুকু হবে বা হবে না- সেটাও নির্ভর করে সেই দেশের জনসাধারণ ও সরকার কীভাবে তা মোকাবিলা করবে তার ওপর। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। এরমধ্যে আমরা যদি চালের উৎপাদন ধরে রাখতে পারি, তাহলে কিছুটা সামাল দিতে পারবো।
এ অর্থনীতিবিদের মতে, আমরা খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলি সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। বলা যেতে পারে, চালে মোটামুটি আমাদের চলে যায়। কিন্তু অন্য কোনো খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। অন্য কোনো দানাদার খাদ্যেও নয়। বলা যায়, আমদানি নির্ভর খাদ্যের ভরসায় রয়ে গেছি আমরা।
এম আসাদুজ্জামান আরও বলেন, সরকার খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার কথা বলছে। কিন্তু কোথায় কতটা উৎপাদন হচ্ছে, কত খরচ হচ্ছে- সে হিসেব নেই। বলার কথা বলে যাচ্ছে। সেটা নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকলে মরতে হবে। তারা (সরকার) আমদানির আশায় বসে আছে। কিন্তু তাতে কত টাকা লাগবে হিসাব আছে? বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম তিনগুণ হয়েছে। কীভাবে সেটা (খাদ্য আমদানি) হবে?
এদিকে, শুধু আসন্ন মন্দা নয়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাপ সামাল দেওয়াও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের খাদ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯৫০ কোটির বেশি হবে। সে সময় খাদ্যের জোগান ঠিক রাখতে এখন যে খাদ্য উৎপাদন করা হয়, এর থেকে ৭০ শতাংশ বেশি উৎপাদন করতে হবে। আর যদি উৎপাদন বাড়ানো না হয় তাহলে ২০৩০ সালে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে খাদ্য সংকটে থাকবে।
বাংলাদেশের জন্য এ সংকট আরও বেশি হতে পারে। আমাদের দেশে জনসংখ্যার চাপ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হবে। ফলে যথেষ্ট উৎপাদন বাড়াতে না পারলে খাদ্য আমদানিতে আমাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি করবে।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর আমরা যে সবুজ বিপ্লব শুরু করেছিলাম, এর সুফল পেয়েছি। উচ্চফলনশীল জাতের জন্য সার্বিক খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার, পেস্টিসাইড, ইরিগেশনসহ বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য আমরা দানাদার শস্যে সাফল্য পেয়েছি। আমাদের সবজি, মাছ ও ফল উৎপাদনে সফলতা রয়েছে। সেই পথে টেকসইভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
তারা বলছেন, শুধু চালের উৎপাদনে সাফল্য নয়, এখন প্রয়োজন গম, ডাল, তেলের মতো জরুরি খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে বড় সাফল্য। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, ভবিষ্যতে কৃষিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সেগুলো হলো- খাদ্যের নিরাপত্তা, টেকসই ও দায়িত্বশীল কৃষি। আমাদের সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়েই অনেক বেশি উৎপাদন করতে হবে। দেশের খোরপোশ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরণ করতে হবে।
এদিকে তথ্য বলছে, যেখানে দেশে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৫ লাখ মানুষ বাড়ছে, সেখানে প্রতিবছর এক শতাংশ করে কৃষিজমি কমছে। বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। জনসংখ্যা অনুপাতে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৪৪ হেক্টর। এরপর আবার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতিবছর দেশের প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, প্রতিবছর দেশের কৃষিজমির পরিমাণ কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর। অর্থাৎ প্রতিবছর এক শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জনসংখ্যার বাড়তি চাপের কারণে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে। কম জমিতে বেশি ফসল ফলানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য টেকসই খাদ্যনিরাপত্তার জন্য আমাদের উচ্চফলনশীল জাত উৎপাদন করতে হবে। আমাদের ভার্টিক্যাল উৎপাদন বাড়াতে হবে। শুধু জাত সম্প্রসারণ নয়, বাড়াতে হবে প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার। একই সঙ্গে কমাতে হবে খাদ্যের উৎপাদনকালীন ও পরবর্তী অপচয়।
এদিকে, খাদ্য নিরাপত্তার থেকে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টি আরও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ৩০-৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রয়োজনের তুলনায় ৭টি অণুপুষ্টি অপর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করে। এর ফলে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
স্বাস্থ্যবিভাগের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু প্রোটিন ও ক্যালরিজনিত পুষ্টিহীনতায় ভোগে। যাদের মধ্যে খর্বাকৃতি ২৮ শতাংশ, কৃষকায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নিম্ন ওজনের ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু রয়েছে। অন্যদিকে গড়ে এক-চতুর্থাংশ নারী দীর্ঘস্থায়ী ক্যালরিজনিত অপুষ্টিতে ভোগেন। যাদের অধিকাংশেরই দেহে একই সঙ্গে জিঙ্ক, আয়রন ও আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, পুষ্টির জন্য ডিম-দুধ বা ফলমূলের মতো ভালো খাবারের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে দারুণভাবে ভোগাচ্ছে। তিনি বলেন, ধরুন প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে হলে চারজনের পরিবারের জন্য প্রতিদিন শুধু ডিমের পেছনে ৬০ টাকা খরচ করতে হবে। এটা বহন করা অধিকাংশের জন্য সম্ভব নয়। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ক্ষেত্রে দাম আরও বেশি। সেজন্য খাদ্যজনিত পুষ্টিহীনতায় উচ্চমূল্য একটি বড় বিষয়।