ঢাকাসহ সারাদেশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার লাগামহীনভাবে বাড়ছে। যা শহর এলাকার তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাপমাত্রা বাড়ায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা, প্রাতিষ্ঠানিক ভবনে এসির ব্যবহার আরও বাড়ছে। এসি ব্যবহারের এই অচ্ছেদ্য চক্রে বিদ্যুতেরও চাহিদার ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ বাড়ছে। যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। একইসঙ্গে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
শুক্রবার (২১ অক্টোবর) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) ভার্চুয়াল ‘আইপিডি নগর সংলাপ’-এ এসব কথা বলেন বক্তারা।
‘ভবনে এসি ব্যবহারজনিত বিদ্যুৎ চাহিদা ও নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি: টেকসই ভবন ও শহর বিনির্মাণে করণীয়’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে আইপিডি।
সংলাপে বক্তারা বলেন, নগর পরিকল্পনা ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সংযোজন এনে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে এসির চাহিদা কমানো সম্ভব। পাশাপাশি টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে এসি ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন। এটা করতে পারলে এসি ব্যবহারজনিত বিদ্যুৎ চাহিদা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। যার মাধ্যমে অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে।
সংলাপে আইপিডির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমানের ‘ভবনে এসি ব্যবহারজনিত বিদ্যুৎ চাহিদা ও নগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার সারাংশ উপস্থাপন করা হয়। এটি উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান।
মূলপ্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রয়োজনে এসির ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা নগর তাপদ্বীপ তৈরি করছে এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। অথচ কার্যকর নগর পরিকল্পনা, ইমারত বিধিমালা এবং এসি ব্যবহারের সঠিক নীতিমালা থাকলে এসির ব্যবহার কমানো যেতো। পাশাপাশি বিদ্যুতের ওপর চাপ বহুলাংশে কমানো যেতো। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতি বছর এসির ব্যবহার ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সারাদেশের ব্যবহৃত এসির সিংহভাগই ঢাকা শহরে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আদিল মুহাম্মদ খানের প্রবন্ধে আরও বলা হয়, নগর এলাকায় কংক্রিট তথা ধূসর কাঠামো বেড়ে যাওয়ায় কয়েক দশকে ঢাকার তাপমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে, যা পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসি ব্যবহারের সময় তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি বাড়িয়ে ২০-৩০ ভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা কমানো সম্ভব। অনুরূপভাবে সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এসির ব্যবহার সীমিত করার মাধ্যমেও সারাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব বাড়িয়ে দেশের বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।
পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, এসির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে এসির ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) সাম্প্রতিক রিপোর্টের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সারা বিশ্বেই এসি ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি নগরের ভবনের আকার-আয়তন বাড়ার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে, যার লাগাম টানা প্রয়োজন।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, নগর এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লটের মধ্যে যে উঁচু ভবনগুলো নির্মিত হচ্ছে, সেখানে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা না থাকাতে মানুষ এসি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত ব্লক ডেভেলপমেন্ট করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থান ও ভবনে আলো-বাতাসের প্রবাহ বাড়িয়ে এসির ব্যবহার কমানো সম্ভব। এতে বিদ্যুতের ওপর চাপ কমবে।
তিনি আরও বলেন, ‘এটা করা না হলে ঢাকা ক্রমান্বয়ে ইট-পাথরের জঞ্জালে পরিণত হবে। বেঁচে থাকার জন্য অবাসযোগ্য ঢাকা ছেড়ে মানুষ অন্যত্র চলে যাবেন, যার নজির বিশ্বের অনেক শহরেই আছে।’