#অবৈধভাবে মার্কেটের জায়গা বরাদ্দ নিয়েছেন দোকানিরা
#১১২টি দোকান নিজ খরচে নির্মাণ করেছিলেন দোকানিরা
নিয়ম না মেনে নির্মাণ করা রাজধানীর নীলক্ষেত তুলা মার্কেট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, তুলা মার্কেটের এ জায়গা অবৈধভাবে বরাদ্দ নিয়েছেন দোকানিরা। পরে নিয়মবহির্ভূতভাবে সেখানে তিনতলা দুটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এখন সেই ভবনগুলো ভেঙে ফেলা ছাড়া বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই।
তবে দোকানিদের দাবি, তারা যথাযথ নিয়মে আবেদন করে মার্কেটের জায়গা বরাদ্দ নিয়েছেন। নিজ খরচে দুটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল হলে এর দায় ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এখন মার্কেট ভাঙা হলে সব ব্যবসায়ী পথে বসবেন। তার চেয়ে ভবনগুলোর বৈধতা দিয়ে নিয়মমাফিক মাসিকভিত্তিতে ভাড়া আদায় করে রাজস্ব আয় করতে পারে ডিএসসিসি।
এরই মধ্যে ডিএসসিসির এ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আগামী ৬ নভেম্বর দুপুর ১২টা হতে নীলক্ষেত রোড সাইড মার্কেটের (তুলা মার্কেট) তিনতলা বিশিষ্ট ভবনের সব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করবেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান।
নীলক্ষেত তুলা মার্কেটের এই ভবন দুটি ভাঙতে আরও ছয় বছর আগে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএসসিসি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মার্কেটটি তখন ভাঙা হয়নি। এরপর থেকে করপোরেশনকে ভাড়া না দিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এবার মার্কেটটি ভাঙতে ডিএসসিসি যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কতটা বাস্তবায়ন হবে এ নিয়ে খোদ করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তাই প্রশ্ন তুলছেন।
সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, নীলক্ষেতের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের উত্তর পাশে ডিএসসিসির প্রায় ৩২ শতাংশ জায়গা রয়েছে। আগে এখানে একতলা একটি মার্কেট ছিল। ২০১২ সালের শুরুতে এই জায়গায় নতুন করে দোকান নির্মাণে (নিজ খরচে) ডিএসসিসির সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান বরাবর আবেদন করেছিলেন নীলক্ষেত সিটি করপোরেশন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এ কে এম সামছুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন। এ আবেদনে সুপারিশ করেছিলেন ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম।
এরপর ওই বছরেরই ১২ এপ্রিল তুলা মার্কেটের ফাঁকা জায়গা ও ছাদে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের সার্ভেয়ার মুরাদ হোসেন ও সৈয়দ রোমান। এ প্রস্তাবের এক পর্যায়ক্রমে একমত পোষণ করে বরাদ্দপত্রে স্বাক্ষর করেন সম্পত্তি বিভাগের কানুনগো মোহাম্মদ আলী, সম্পত্তি কর্মকর্তা দিদারুল আলম, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান উল ইসলাম চৌধুরী। একই বছরের ১০ মে প্রতি বর্গফুট ১৫ টাকা হারে ১১২টি দোকান ভাড়া এবং দোকানিদের নিজ খরচে পাকা ভবন নির্মাণের শর্তে বরাদ্দ দেন ডিএসসিসির তৎকালীন প্রশাসক খলিলুর রহমান। তখন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া ছয়তলা ভিত্তির ওপর তিনতলা দুটি ভবন নির্মাণ করে লাবলু অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
মার্কেটের জায়গা বরাদ্দের পর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক প্রশাসক খলিলুর রহমান বদলিতে যান। এরপর মার্কেটের বরাদ্দের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসসিসির সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল-হারুনকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সংস্থাটি। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পর্যায়ক্রমে তুলা মার্কেটের জায়গা বরাদ্দে সুপারিশ করেছিলেন ডিএসসিসির উল্লিখিত সাত কর্মকর্তা। এই সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই বহুতল ভবন নির্মাণ করেন এ কে এম সামছুদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন। ফলে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। এছাড়া অবৈধ ওই বরাদ্দ বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত কমিটির এমন সুপারিশের পর ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর ওই সাত কর্মকর্তা ও তুলা মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির দুই নেতার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। এরই মধ্যে ২০১৫ সালে ডিএসসিসিতে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিও তুলা মার্কেটের ভবন নির্মাণে অনিয়মের ঘটনা তদন্ত করতে সাবেক প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমেদকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিলেন। ওই কমিটির প্রতিবেদনেও পুরো বরাদ্দ প্রক্রিয়াটিকে ‘অবৈধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কমিটি সব বরাদ্দ বাতিল করে ভবনটি উচ্ছেদের সুপারিশ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভবনটি ভাঙা হয়নি।
নীলক্ষেতে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের উত্তর পাশে লম্বালম্বিভাবে (পূর্ব-পশ্চিম) নির্মিত পৃথক দুটি ভবন নিয়ে তুলা মার্কেট। সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজের উত্তর পাশের ফটক বরাবর ভবন দুটি ১০ ফুট করে ফাঁকা রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে। নিচতলায় লেপ-তোশকের দোকান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের শাখা অফিস। সেখানে গিয়ে চেষ্টা করেও নীলক্ষেত সিটি করপোরেশন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এ কে এম সামছুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেনকে পাওয়া যায়নি। এমনকি দোকানিরাও তাদের কাছে নম্বর নেই বলে জানান।
ওই মার্কেটের ফিরোজ বেডিং স্টোরের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আগে তুলা মার্কেটের এই জায়গায় একতলা একটি লম্বা ভবন ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মার্কেটটির ব্যবসায়ীরা শান্তিতে নেই। সিটি করপোরেশন থেকে বারবার উচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ দোকানিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখন মার্কেটটি ভাঙার চেয়ে বৈধতা দিলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।
২০২০ সালে ডিএসসিসি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনিও তুলা মার্কেট নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টি অবগত আছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি করপোরেশন মার্কেটটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ। তবে ঠিক কবে নাগাদ ভবন ভাঙা বা উচ্ছেদের কাজ শুরু হবে, তা জানতে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি সিরিভ করেননি।
সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, তুলা মার্কেটের বরাদ্দ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সবকিছু অবৈধভাবে করা হয়েছে, এটি সবাই জানেন। কিন্তু অজানা কারণে মার্কেটের ভবন দুটি উচ্ছেদ বা ভাঙা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, বরং এটিই এখন তদন্তের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।