ধেয়ে আসছে বিশ্বমন্দা। এ মন্দার কারণে আগামী বছর বিশ্বব্যাপী দেখা দিতে পারে খাদ্যসংকট। এরই মধ্যে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপও বেড়েছে। মন্দার কারণে খাদ্যসংকট দেখা দিলে এ চাপ আরও বাড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একাধিকবার খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে এমন পরিস্থিতিতেও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন কোনো ইনোভেটিভ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য উৎপাদনে প্রতিবছর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এবার তা আরও জোরদার করা হবে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে প্রণোদনা হিসেবে অধিক সংখ্যক কৃষককে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আগামী বছর খাদ্য সংকট দেখা দিলে পরিস্থিতি অনেক খারাপের দিকে যেতে পারে। সে কারণে খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে ২৭ লাখ কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ দেওয়া হবে। প্রণোদনা হিসেবে এসব সার ও বীজ বিনামূল্যে পাবেন কৃষকরা। পাশাপাশি যৌথভাবে অনেক কৃষকের জমিতে একসঙ্গে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করেছে। সংস্থা দুটি বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫ দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এফএও এবং ডব্লিউএফপির যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রবল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে মন্দা ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন। সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি আমাদের যুবকদের প্রতি, তাদের নিজ নিজ এলাকায় খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য আরও উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাতে চাই। যদি তা করা হয়, তাহলে আমরা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবো। অন্যান্য দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশেও সাহায্য করতে পারবো।
সরকারপ্রধান বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ আঘাত হানতে পারে। অনেক উন্নত দেশে এখন অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন। বাংলাদেশকে এর প্রভাব থেকে (যেকোনো বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক মন্দা) মুক্ত রাখতে, দেশে প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসলের আবাদ করতে হবে। এছাড়া খাদ্যপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণরাই বাংলাদেশের শক্তি। আমাদের দেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর। তার চেয়েও বড় শক্তি আমাদের জনশক্তি। এ শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
এর আগে ১৭ অক্টোবর ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করছি, কোনো খাদ্যের যেন অপচয় না হয়। পাশাপাশি যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, তা চাষের আওতায় এনে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ান। সারা বিশ্বে যে দুর্যোগের আভাস আমরা পাচ্ছি, তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন। আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রচেষ্টায় এটা করা সম্ভব।’
এর আগে ১১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সাপ্তাহিক সভায় দেওয়া সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সফরের সময় আমি অনেক বিশ্বনেতা ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যেকেই এ বিষয়টি (খাদ্য নিরাপত্তা) নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন যে, ২০২৩ সাল খুব ভয়াবহ বছর হবে। এ বছরে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যখন বারবার খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ আসছে, সেসময় দেশের ভেতরে উৎপাদন বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্ন রাখা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলমের কাছে।
জবাবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা যেতে পারে- এমন শঙ্কার মধ্যে সবাই আছেন। আমরা যাতে খাদ্য সংকটে না পড়ি, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের যেভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, দেশে খাদ্যের সমস্যা হবে না। এরই মধ্যে আপনারা শুনেছেন, কয়েক বছর ধরেই আমাদের আমদানি কমে আসছে। এর প্রধান কারণ হলো- আমরা নতুন জাতগুলো থেকে ভালো ফলন পাচ্ছি। বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা এবার ২৭ লাখ কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে সার ও বীজ দিয়ে সহায়তা করবো। যাতে কোনোভাবে উৎপাদন না কমে। বরং আগের চেয়ে উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি।
বেনজীর আলম বলেন, প্রতি বছর ২২-২৫ লাখ নতুন মুখ আসছে। এটার জন্য এমনিতেই আমাদের বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে খাদ্য ঘাটতি হবে। খাদ্য বলতে এখন আমরা প্রধানত ভাতকে বুঝিয়ে থাকি। ধান উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের নতুন জাত আছে। ৮৯, ৯২, ১০০ জাতের ধানের ফলন অনেক বেশি। দেশের বিজ্ঞানীরা এসব জাত উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো আমরা ব্যবহার করছি। পাশাপাশি হাইব্রিডের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি, যদিও এগুলো একটু মোটা ধান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, বীজ সরবরাহ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সরকারিভাবে বেশি পরিমাণ বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করছি। যৌথভাবে অনেক কৃষককে একসঙ্গে নিয়ে ১০০-১৫০ বিঘা জমিতে আমাদের তত্ত্বাবধানে উৎপাদন হচ্ছে। মানিকগঞ্জসহ তিন জেলায় উচ্চফলনশীল জাত এবারের বোরো মৌসুমে আমরা ব্যবহার করতে পারবো।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশের মানুষকে খাওয়াতে বছরে তিন কোটি ৫০ লাখ টন চাল ও ৫০-৬০ লাখ টন আটা লাগে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মতো দেশীয় জোগান থেকে আসে। বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১৬ লাখ টন খাদ্যের মজুত আছে। এর মধ্যে চাল প্রায় ১৪ লাখ টন, গম এক লাখ ৮০ হাজার টন। আর গুদামে ধান আছে ২০ হাজার টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএসের) ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ৩৩৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। এর সঙ্গে ১৩ লাখ টন গম ও ৩০ লাখ টন ভুট্টাসহ বছরে মোট ৩৮১ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে যে আমন ধান উৎপাদন হয়েছে, তা থেকে এক কোটি ৫৭ লাখ টন চাল পাওয়া গেছে। এ বছর সারাদেশে ৫৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। তাতে এক কোটি ৫৯ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে ধরে নেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে ১৯ জেলায় ৩৩ হাজার জমির আমন ধান গাছ হেলে পড়েছে।
অবশ্য এতে খুব বেশি সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং যে অঞ্চলে আঘাত করেছে, সেখানে সাধারণত দেরিতে বীজ রোপণ করা হয়। আমাদের হিসাবে ওই অঞ্চলে ৫ শতাংশের মতো আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খুব একটা ক্ষতি হবে না বলে আমরা আশা করছি। যদি নতুন করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড় না আসে, তাহলে দেশে ইনশাল্লাহ খাদ্যের সংকট হবে না।
এদিকে, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের ভেতরে বিভিন্ন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। পণ্যের বাড়তি দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা নিম্নআয়ের মানুষের। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরু চাল ৬৫-৭৫ টাকা এবং মোটা চাল ৮-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর খোলা আটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা এবং প্যাকেট আটা ৬০-৬৩ টাকা। একবছর আগের তুলনায় চালের দাম ১৩ শতাংশ ও আটার দাম ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
অবশ্য রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চাল ও আটা আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা মোটা চাল ৫২-৫৬ টাকা কেজি বিক্রি করছেন। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৮০ টাকা দরে। খোলা আটা ৬০-৬৫ টাকা এবং প্যাকেট আটা ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মালিবাগ হাজীপাড়ার ব্যবসায়ী মো. আফজাল বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে চাল ও আটার দাম বেড়ে গেছে। এখন আমাদের যে দামে কিনতে হচ্ছে তাতে খোলা আটার কেজি ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ নেই। দুই কেজির প্যাকেট আটা ১৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকা কেজি। ৬৮ টাকার নিচে মিলছে না কোনো চিকন চাল।
খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে চাপে পড়া মানুষের ওপর সামনে চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ কারণে তারা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান এবং অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে, তা বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে। বাংলাদেশের একার পক্ষ মন্দা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি অভিঘাত আসে। তাই নিম্নআয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে।
অবশ্য বাংলাদেশে খাদ্যের সংকট হবে না বলে আশা করছেন সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ওতটা আতঙ্কিত না। কারণ বাংলাদেশে কৃষির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আমার ধারণা, খাদ্য পরিস্থিতি আমরা মোকাবিলা করতে পারবো। তবে টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর মনিটরিং এবং সংখ্যা বাড়াতে হবে।