বেগমগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদে ২৭০ নম্বর আসন নোয়াখালী-৩। বিএনপির দুর্গখ্যাত প্রবাসী অধ্যুষিত এ আসন গত দুবার আওয়ামী লীগের দখলে। স্থানীয় এমপি এলাকায় সময় দেন। ব্যক্তি ইমেজ বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে ভালো। তুলনামূলক ভোটও বেড়েছে আওয়ামী লীগের। তবে দলের গলার কাঁটা এখন কিশোর গ্যাং ও তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। এই গ্যাং কালচারকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ খোদ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে ১৯৯১ থেকে টানা পাঁচবার এ আসনে জয়ী বিএনপি। এখনো দলগত ভোট বিএনপিরই বেশি।
সংসদীয় আসনের হালাচাল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা জানিয়েছেন, স্থানীয় এমপি এখানে বেশ জনপ্রিয়। এলাকার নানান উন্নয়নকাজ ও মানুষের প্রয়োজনে তাকে পাওয়া যায়। বিএনপি নেতা বরকত উল্যাহ বুলুর তুলনায় ভালো। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তার অনুসারী নেতাদের ছত্রছায়ায় এলাকায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। যারা ডাকাতি, ছিনতাই এমনকি খুন-খারাবি পর্যন্ত করে। এলাকার লোকজন মনে করেন, এ সমস্যা সমাধানে হয় এমপিকে কঠোর হতে হবে, না হয় ক্ষমতার পালা বদল লাগবে।
মাস্টারপাড়া এখন ‘নষ্টপাড়া’
স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত নিয়ে অতিষ্ঠ এলাকার লোকজন। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপে বেগমগঞ্জের লাউতলীর ফারুক হোসেন নামে একজন বলেন, আগে এলাকার নাম রাখছিলাম মাস্টারপাড়া। এখন দু-একটা ছেলের কাণ্ডে নাম পাল্টে আমিই রাখছি ‘নষ্টপাড়া’।
তিনি বলেন, এগুলোরে কেউ শিশুলীগ কয়, কেউ কয় কিশোর গ্যাং। মাত্র দু-তিনটা ছেলের কারণে এ অবস্থা। কারও ঘরে ১০-২০ হাজার টাকা আছে জানলেও টার্গেট করে ডাকাতি করে। বাচ্চা বাচ্চা এসব পোলাপান গা ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় হাটে। গাড়ি একটা গায়ে লাগলেও ফোন দিয়ে ২০-৫০ জন জড়ো করে মারামারি করে, গাড়ি ভাঙচুর করে। কেউ প্রতিবাদ করে না, তামাশা দেখে। প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা বলে আমরা করি আওয়ামী লীগ, এরা কী করে আল্লাহ জানে। ইজ্জতের ভয়ে কেউ কিছু বলে না।
এক সময় ছাত্ররাজনীতি করা ফারুক হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় এই গ্যাং কালচার চলছে। এটার প্রতিফলন কিছুদিনের মধ্যেই হবে। এজন্য নষ্ট কিছু অভিভাবক দায়ী। কারণ, সন্তান কোথায় যায়, তারা খবরও নেন না। আর দায়ী রাজনীতিবিদরা। কারণ নেতারাই তাদের সাপোর্ট দেন। বিএনপি অধ্যুষিত এলাকায় পোলাপান সাপোর্ট না দিলে তাদের সঙ্গে থাকবে কে?
এই গ্যাং কালচারের প্রশ্রয়ের তীর খোদ এমপির দিকে দিয়ে কাজী নগর গ্রামের জামাল হোসেন বলেন, ‘কিরণ সাব ল্যাংকা পোলাপান (কিশোর গ্যাং) পালে। এগুলো ছ্যাঁচড়ামি, দালালি করে। মানুষ এগুলোতে অসন্তুষ্ট।’
এই কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. এবিএম জাফর উল্লা জাগো নিউজকে বলেন, কিশোর তো নাই, এগুলো সব যুবক হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যকার কেউ কেউ ওদের প্রশ্রয় দেয়। না হলে এদের গোড়া কোথায়? এদের খুঁটি কোথায়? আজ এত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এরা এত সাহস পায় কই? গ্যাংস্টার! এগুলো আমি পাত্তা দেই না।
ভোটে বিএনপি ৬৫% আওয়ামী লীগ ৩৫%
বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রার্থীদের অবস্থা নিয়ে এলাকা ঘুরে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। তারা বলছেন, দলগতভাবে এখানে বিএনপি জনপ্রিয়। তাদের ভোট ৬৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগের ৩৫ শতাংশ। তবে ব্যক্তি হিসেবে দুই দলের প্রার্থী কিরণ ও বুলুর মধ্যে কিরণ বেশি জনপ্রিয়।
বেগমগঞ্জের কাজীনগর রাস্তার মাথায় চা দোকানের আড্ডায় জাগো নিউজের সঙ্গে স্থানীয় জয়নাল আবেদীন মানিক সরকার বলেন, আমরা কার হাতে দেশটা দেবো? তারা ক্ষমতায় গিয়ে কী করবে, সেটা বলুক। চালের কেজি ৬০ টাকা, ৪০ টাকায় খাওয়াবে বলুক। বা তেল-গ্যাসের দাম কমাবে বলুক। তাহলে আমরা বিবেচনা করবো।
তিনি বলেন, এলাকায় কাজ বেশি করেছেন কিরণ (বর্তমান এমপি) সাহেব। বুলু (বিএনপি নেতা) তো নিজের বাড়ির রাস্তাটাই করতে পারেননি। এর আগে যা করছে জাবেদ (সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের ভাই) সাহেব করছেন, পরে কিরণ সাহেব।
বিএনপির প্রার্থী বুলু সাহেব এলাকায় আসেন কি না, লোকজনের খবর নেন কি না, জানতে চাইলে বিএনপির কর্মী ও ভোটার মো. জামাল হোসেন বলেন, বুলু সাহেবের খবর আমরা রাখি না। আমরা তো জিয়াউর রহমানের দল করি। দল থেকে বুলু সাহেবকে দিছে, ভালো খারাপ যাই হোক, তার পেছনে আছি।
তিনি বলেন, এখানে বিএনপির ভোট ৬৫ শতাংশ, আওয়ামী লীগের ৩৫ শতাংশ। তবে ব্যক্তি হিসেবে কিরণ সাহেব ৬৫ শতাংশ এবং বুলু সাহেব ৩৫ শতাংশ জনপ্রিয়।
জহিরুল ইসলাম পেশায় অটোচালক। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি (দরবেশপুর)। তিনি বলেন, তুলনামূলক এলাকায় বেশি আসেন কিরণ সাহেব। কাজও করেন।
হোটেল ব্যবসায়ী মো. আক্কাস বলেন, সুষ্ঠু ভোট হলে আমি আশাবাদী আওয়ামী লীগ পাস করবে।
বিএনপিতে একক প্রার্থী, আওয়ামী লীগে ৩
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আলোচনায় আছেন বর্তমান এমপি মামুনুর রশিদ কিরণ, বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম জাফর উল্লা এবং সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের ভাই মিনহাজ ইউ আহমেদ জাবেদ।
এদিকে, বিএনপির একমাত্র প্রার্থী দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী বরকত উল্যাহ বুলু।
মনোনয়নের বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. এবিএম জাফর উল্লা বলেন, ‘মনোনয়নের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
দলীয় অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে নৌকার ভোট বাড়ছে। কিন্তু নৌকার লোকজনের আচরণ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নেতাদের বিভিন্নমুখী কার্যকলাপ আমাদের বিরুদ্ধে গেছে। ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে দলীয় প্রার্থীর জয় হয়েছে মাত্র আটটিতে। আমাদের কোনো কোনো নেতা বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের বিদ্রোহীপ্রীতি আছে। যে কারণে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে।
বিএনপির একক প্রার্থী, তাদের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করার মতো অবস্থা আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, বিএনপিতে গ্রুপিং নেই ঠিক। ওদের গ্রামাঞ্চলে পোলাপান বেশি। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বেশি। তাদের দমন করা গেলে আমাদের প্রার্থী জয়ী হবে।
চৌমুহনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র আক্তার হোসেন ফয়সল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দল করি। দলের সিদ্ধান্ত যেটা, সেটার সঙ্গেই আছি।’
জাতীয় সংসদের ২৭০ নম্বর এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯২ হাজার ২৯৮। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ২ হাজার ৬৮৬ ও নারী ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬১২। পঞ্চম থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ছিল বিএনপির দখলে। দশম ও একাদশে আওয়ামী লীগ।