বিএনপির পূর্বনির্ধারিত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন রাজধানীর নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তায় যাতায়াতকারী অনেককে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে সে রাস্তায় চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া বিএনপি কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে। পুরো এলাকায় এক ধরনের গোমট পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সরেজমিনে শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে নয়াপল্টন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
গত বুধবার বিকেলে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকেই কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। পুরো এলাকা রয়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপির নেতাকর্মীদের নেই কোনো আনাগোনা।
সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে চলাচলকারী অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে পুলিশ।
সেখানে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেছেন, সকাল থেকেই রাস্তা বন্ধ রয়েছে। এ সড়কে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির ৪৭৩ নেতাকর্মীর নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দেড় থেকে দুই হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। পুলিশের ওপর হামলা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করেছে।
মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপাসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল।
গত বুধবার বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন অনেকে। এসময় বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে চাল, পানি, খিচুড়ি, নগদ টাকা ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাওয়া যায় বলে জানায় পুলিশ।
অভিযান চলাকালে নয়াপল্টন থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এ মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ ৪৩৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। আর ১৪ নেতাকর্মীকে দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই মামলায় ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত।
কারাগারে যাওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি প্রমুখ।
নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা পৃথক মামলায় বিএনপির আরও ৯ নেতাকর্মীকে একই আদালত বৃহহস্পতিবার দুদিনের রিমান্ড দিয়েছেন। রিমান্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বিএনপির জামিল হোসাইন, হারুনুর রশীদ, রিয়াদ আহমেদ, রবিউল ইমরান, জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু, মোস্তাক মিয়া, মাহাবুব মিয়া, খোরশেদ আলম সোহেল ও সোহাগ মোল্লা।
আগামী ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। তবে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে দলটিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। পরে বিকল্প হিসেবে টঙ্গী ইজতেমা মাঠ বা পূর্বাচলে বিএনপিকে সমাবেশ করতে বলা হয়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া ঢাকার ভেতরে সমাবেশের বিকল্প ভেন্যু পেলে বিএনপি বিবেচনা করবে বলে জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এদিকে গত বুধবারের সংঘর্ষ ঘিরে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নয়াপল্টন এলাকায় স্থবিরতা বিরাজ করে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-কর্মস্থল বন্ধ থাকতে দেখা যায়। পুরো এলাকায় সতর্ক অবস্থান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওইদিন সকালে বিজয়নগর মোড়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে দলীয় কার্যালয়ে যেতে পারেননি মির্জা ফখরুল ইসলাম।
এর আগে গত বুধবার সকাল থেকে নয়াপল্টনের একপাশের সড়ক দখলে নেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। জড়ো হওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিকেল তিনটার দিকে লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। নেতাকর্মীরাও পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মারমুখী হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যান চলাচলের বিঘ্ন ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা ছাড়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে তারা রাস্তা থেকে সরে না গিয়ে হঠাৎ করেই পুলিশের ওপর হামলা চালায়। মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়াপল্টন এলাকা। মুহুর্মুহু টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপে কাকরাইল, বিজয়নগর, পল্টন, মতিঝিল, শান্তিনগর এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবহার করা হয় রায়টকার ও জলকামান।
সংঘর্ষে নিহত মকবুল হোসেন বিএনপির কর্মীর বলে দাবি করেছে দলটি।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশ কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রায় সব প্রবেশমুখ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। ঢাকার প্রধান প্রবেশমুখগুলোতে বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। কাউকে সন্দেহ হলেই তল্লাশি করা হচ্ছে। গাড়ি থামিয়েও চলছে তল্লাশি।