ন্যায়বিচারের সঙ্গে দেশপ্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট। লালমনিরহাটে পরিত্যক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তি নিয়ে আদালত অবমাননার অভিযোগের এক শুনানিতে আদালত এ কথা বলেন।
বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) এ কথা বলেন।
এদিন শুনানিতে এক সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা হাইকোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৫ জুন দিন ঠিক করেছেন আদালত।
শুনানিতে সচিবকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, আপনি এসেছেন, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হলো। দেশ ও আমাদের সম্মান দেখানো হলো। ন্যায়বিচারের সঙ্গে দেশপ্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক। অনেকে মনে করেন আদালতে ডাকলে হিউমিলিটিং (অপমান) করা হয়, আসলে কিন্তু তা নয়। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
এসময় লালমনিরহাটে পরিত্যক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত এক সম্পত্তি অবমুক্তি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার দেওয়া চিঠি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, যে বিষয়টি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, তা নিয়ে আইন কর্মকর্তা শুনানির জন্য চিঠি দিতে পারেন কি? নতুন করে শুনানির সুযোগ নেই। যদি কেউ তা করেন, তা অবিশ্বাস্য ও অবমাননাকর।
আদালতে সচিবসহ তিন কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সুকুমার বিশ্বাস ও নজরুল ইসলাম খন্দকার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস-আল-হারুনী।
ওই সম্পত্তি অবমুক্তি নিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় মো. হাশিম নামের এক ব্যক্তি আদালত অবমাননার অভিযোগে আবেদনটি করেছিলেন। এর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, উপ-সচিব অভিজিৎ রায় ও যুগ্ম সচিব (আইন শাখা-১) মো. জহিরুল ইসলাম খানকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়। সে মোতাবেক তারা আদালতে হাজির হন।
তাদের কেন আদালতে ডাকা হয়েছে, তা উল্লেখ করে মামলার ঘটনাক্রম তুলে ধরেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, সম্পত্তি ‘ক’ তালিকাভুক্ত হওয়ায় হাশিম ২০০২ সালে রিট করেন। তার বাড়ি ওই তালিকায় পড়েছে। হাইকোর্ট ২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেন। একটি লোক মামলা করলো, ফল পেতে এক যুগ সময় লাগলো? ১২ বছর কেন লাগবে? এর দুই বছর ‘লিভ টু আপিল’ করা হয়, যা ২০১৬ সালে খারিজ হয়। এর বিরুদ্ধে রিভিউ করলে ২০১৮ সালে তা-ও খারিজ হয়। ২০১৮ সালে বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো। এরপর আরও কয়েক বছর গেলো, রায়ের ফল ঘরে তুলতে পারলো না। ফলে তিনি আদালত অবমাননার মামলাটি করেন।
আদালত বলেন, লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এসে এর আগে সময় চান, সময় দেওয়া হয়। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন নিয়ে সভা করেন। সম্পত্তিটি বুঝিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্তের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় চিঠি পাঠানো হয়। যুগ্ম সচিব (আইন) মালিকানা-সংক্রান্ত কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য হাশিমকে হাজির হতে বলেন। আরেক কর্মকর্তা অভিজিৎ রায়ের চিঠিও দেখা যায়।
দুটি চিঠি বিস্মিত করেছে উল্লেখ করে হাইকোর্ট আরও বলেন, যে বিষয়টি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়ে গেল, তা নিয়ে নতুন করে শুনানির সুযোগ নেই। একটি মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত শুনানি ও নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন ছাড়া যাচাই-বাছাই করার সুযোগ নেই। সম্পত্তি অবমুক্তের সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন শুধু গেজেট করা বাকি। যদি প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে অবমুক্ত করে আবার অধিগ্রহণ করে নিতে পারেন।
সচিবের উদ্দেশে আদালত বলেন, একজন মানুষ ২১ বছর মামলা নিয়ে লড়াই করছেন। সুপ্রিম কোর্ট দেখে রায় দিয়েছেন। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কীভাবে আবার শুনানি করে? আপনার মন্ত্রণালয় থেকে হয়েছে, তাই অবহিত করছি।
তখন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিতে অনেক বাড়ি আছে, যেগুলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি। ভূমিদস্যু ও প্রতারক শ্রেণি মামলা করে বড় বড় সম্পত্তি নিয়ে যায়। আদালতের রায়ের মাধ্যমে এর অনেকগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। তথ্য গোপন করে সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া হয়। সচিব পদের বিপরীতে ১৩০টি অবমাননার মামলা আছে। এক্ষেত্রে (হাশিম) ভুলক্রমে উঠেছিল।
২০১৮ সালে আদালতের রায় হয়েছে। রায় অনুসারে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগে। এর আগে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সম্পত্তি অবমুক্তি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সামারি (সারসংক্ষেপ) পাঠাতে হয়। সঠিকতা সাপেক্ষে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। যার যা প্রাপ্য, তা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকবে—এজন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, জমি চাষ করে ফসল নিয়ে যেতে না পারলে মানুষ সে জামিতে ফসল চাষ করবে কেন? যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তাকে (হাশিম) ডাকতে পারে না। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকের (ডিসির) কাছে ডমুমেন্ট (নথি) চাওয়া যেতো। এজন্য তিন মাস সময় দিচ্ছি। পরে আদালত ৫ জুন পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।