এ সিনেমার মধ্য দিয়ে এই ‘সত্য’ তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান, ব্রিটিশের হাতে টিপু সুলতান মরেননি, তাঁকে মেরেছিলেন কর্ণাটকের এই দুই বীর উরি ও নানজে গৌড়া, যাঁরা ছিলেন রাজ্যের প্রভাবশালী ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের মানুষ।
বিজেপি কিছুদিন ধরেই এবারের ভোটযুদ্ধকে টিপু সুলতান বনাম সাভারকরের অনুগামীদের প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। রাজ্যের বিজেপি সভাপতি নলীন কাটিল গত মাসে সরাসরি তা জানিয়েও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, টিপুর বংশধরদের শেষ করে দিতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সাভারকরের অনুগামীদের। প্রকাশ্যে বলেছিলেন, লড়াই হবে সাভারকর বনাম টিপু সুলতানে।
সেই লড়াইয়ে উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়ার বীরত্ব চিত্রায়িত করার প্রয়োজন কোথায়? এখানেই রয়েছে রাজ্যের জাতভিত্তিক রাজনীতির ঝলক। কর্ণাটকের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক দুই হিন্দু সম্প্রদায়। লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা। রাজ্যের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ লিঙ্গায়েত, ১৪ শতাংশ ভোক্কালিগা। রাজ্য রাজনীতির ক্ষমতার শীর্ষে এই দুই সম্প্রদায়ই বরাবর আসীন থেকেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) নেতা এইচ ডি দেবেগৌড়া। তিনি ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর পুত্র এইচ ডি কুমারস্বামী রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। কর্ণাটকের সাবেক মহীশুর (অধুনা মাইসুরু) অঞ্চলে ভোক্কালিগা সমাজই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী।
ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের শক্তিধর দল কংগ্রেস ও জেডিএস। বিজেপি কখনো দাঁত ফোটাতে পারেনি। এ অবস্থায় ভোক্কালিগা সমাজের মন জিততে উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়ার মতো দুই ‘কাল্পনিক’ চরিত্রের জয়গান গাইতে বিজেপি উঠেপড়ে লেগেছে। তারা মনে করছে, এ সিনেমা তৈরির উদ্যোগ দুটি পাখি একসঙ্গে মারতে পারবে। ভোক্কালিগা সমাজের সমর্থন পাবে বিজেপি এবং টিপু সুলতানের অনুগামীদের পেছনে ফেলে সাভারকরের অনুগামীরা ক্ষমতাসীন হবেন।
ইতিহাসে অবশ্য উরি গৌড়া-নানজে গৌড়ার বীরত্বের কাহিনি স্থান পায়নি। ইতিহাস বলে, মহীশুরকে আগ্রাসী ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচাতে টিপু সুলতান শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কী? বিজেপি ওই ‘একপেশে ইতিহাসই’ তো বদলাতে চায়। তারা ভারতের নতুন ইতিহাস লিখতে চাইছে। সেই ইতিহাসে তারা স্থান দেবে উরি গৌড়া-নানজে গৌড়াকে। বিজেপির ভোক্কালিগা নেতা রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক সি টি রবি ও দুই মন্ত্রী অশ্বত্থ নারায়ণ এবং গোপালাইয়া উরি গৌড়া-নানজে গৌড়াকে নিয়ে সিনেমা করার প্রস্তাবকে সমর্থনও করেছেন।
বিরোধিতাও যে নেই তা নয়। কংগ্রেস ও জেডিএস নেতারা একযোগে বলেছে, বিজেপির এ আখ্যান মনগড়া ও কাল্পনিক। উরি ও নানজে গৌড়াদের কোনো অস্তিত্ব কোথাও নেই। কাল্পনিক চরিত্র বাস্তব হয় না। কল্পনাতেই থেকে যায়। দুই দলের চোখেই টিপু সুলতান ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী।
ভোক্কালিগা সমাজের শ্রী আদি চুনচানগিরি মহাসংস্থান মঠের প্রধান ধর্মগুরু নির্মলা নন্দনাথ মহাস্বামীজি আসরে নেমেছেন। মন্ত্রী মুনিরত্নর সঙ্গে তিনি দেখা করে বলেছেন, সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্ত এখনই যেন না নেন। তাঁর নির্দেশ, টিপুর হত্যাকারীদের নিয়ে কোনো সিনেমা বা অন্য কিছু তৈরির আগে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক সব তথ্য আগে মঠের কাছে জমা দেওয়া হোক। মঠ তা বিচার করবে। মহাস্বামীজি সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, কোনো সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিকে নিয়ে মনগড়া আখ্যান তৈরির অধিকার কারও নেই। ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণিত হলে অন্য কথা।
কর্ণাটক ধরে রাখতে বিজেপির চেষ্টার অন্ত নেই। হিন্দু-মুসলমানে রাজ্যকে ভাগ করতে টিপু সুলতান তাদের অনেক দিনের হাতিয়ার। করোনাকালে স্কুলপড়ুয়াদের চাপ কমাতে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে হায়দর আলী-টিপু সুলতানের গোটা অধ্যায়টাই বিজেপি সরকার বাদ দিয়ে দেয়। মহীশুরের ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা থেকে মুসলমান স্থাপত্য বাদ দেওয়া হয়। বিজেপির প্রচারে টিপু ‘হিন্দু হত্যাকারী’। টিপুর মসজিদ হিন্দু মন্দির ভেঙে গড়া।
ধর্মীয় মেরুকরণের স্বার্থে শাসক বিজেপি রাজ্যে জন্ম দিয়েছে হিজাব বিতর্কের। ব্যবস্থা নিয়েছে আজানের মাইক বন্ধ করার। ঘৃণা ভাষণ বন্ধে সুপ্রিম কোর্ট কড়া বার্তা দিলেও মেরুকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত। নানা কারণে বিপর্যস্ত কর্ণাটকের বিজেপি ধরেই নিয়েছে, ধর্মীয় মেরুকরণই তাদের একমাত্র শেষ পারানির কড়ি। সাভারকর ও টিপু সুলতানের দ্বৈরথের লক্ষ্য যেমন তা, তেমনই তারা হাতিয়ার করতে চাইছে দুই ভোক্কালিগা বীর উরি গৌড়া ও নানজে গৌড়াকে।