মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি)।
জামায়াত ও চলমান রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার ড্রাফট আপনি করেছিলেন বলে আগের পর্বে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন আসন্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হচ্ছে। আপনাদের অবস্থান কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ভোটাধিকারের জন্য আমরা পাকিস্তান আমল থেকে সংগ্রাম করে আসছি। সর্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে- এই দাবিতে আন্দোলন করেছি ক্যাম্পাসসহ পুরো রাজধানীতে। গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়েছি এবং এই দাবিতে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটিয়েছি।
সেই লড়াই একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিলো। আমরা দেশ স্বাধীন করলাম। আমরা ভেবেছিলাম, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু আজও হয়নি। আমাদের সে লড়াই এখনো চালিয়ে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই সমস্যা বাড়তে থাকলো।
জাগো নিউজ: এই ক্ষোভের কথা বহুবার শুনিয়েছেন। ভোট-ভাতের অধিকার নিয়ে এখনো আন্দোলন করতে হচ্ছে। তার মানে আপনারা সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করতে পারলেন না?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মনে হয়, শেষ জাজমেন্ট (রায়) দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। এরকম প্রশ্ন সব সময় শুনতে হয়। সূর্যসেনকেও শুনতে হয়েছিল। তাকেও শুনতে হয়েছিল ব্রিটিশদের কিছুই করতে পারবেন না। আমরাও শুনেছি, আইয়ুব খান লৌহমানব। সরানো যাবে না। এমনকি এরশাদের সময়ও শুনতে হয়েছে, এই স্বৈরশাসককে সরানো সম্ভব নয়।
চির সত্য হলো কোনো স্বৈরশাসকই টিকতে পারে না। ইতিহাসের শেষ রচয়িতা জনগণ। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
জাগো নিউজ: কিন্তু জনগণের এই ক্ষোভ সিপিবি কখনই কাজে লাগাতে পারেনি।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: কাজে লাগানোর বিষয় নয়। সঙ্গে থাকার বিষয়।
জাগো নিউজ: আপনাদের আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলে অন্যরা। বারবার বেহাত হয়ে যায়। ভোট, নির্বাচন নিয়ে সিপিবির মধ্যে দ্বি-চারিতা তীব্র।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আজ থেকে দু’শ বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতায় আসার কথা ছিল। আমার খুশি হওয়ার মধ্য দিয়ে তো ইতিহাস রচিত হয় না। ইতিহাস রচিত হওয়ার কিছু উপাদান থাকে। সেই উপাদানের কতগুলো ঘাত-প্রতিঘাত ও বস্তুনিষ্ঠ ঘটনার মধ্য দিয়ে ফলাফল নির্ধারিত হয়। ১৯৭১ সালের সামাজিক বাস্তবতার কারণে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সামনে চলে এলো।
যদিও ছয় দফার আগ পর্যন্ত বামপন্থিরাই আন্দোলনে এগিয়ে ছিল। বামপন্থিদের কতগুলো ত্রুটির কারণে তারা পিছিয়ে গেলো। আন্দোলন চলে গেলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। মধ্যবিত্তের পরিচালিত দলটিরও শ্রেণি চরিত্র বদলে গেছে। এখন কোটিপতি না হলে আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া যায় না।
জাগো নিউজ: চরিত্র বদল হচ্ছে বামপন্থিদেরও, এমন অভিযোগ পুরোনো। ইতিহাসের উপাদান খুঁজতে খুঁজতে বামপন্থিরা দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে কি না?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ঢালাওভাবে বামপন্থিদের এভাবে মূল্যায়ন করলে হবে না। ভোগবাদী, পুঁজিবাদী সমাজ সব সময় আকর্ষণ করে। অনেকেই এই আকর্ষণ এড়িয়ে আদর্শ টিকিয়ে রাখে। অনেকেই তা পারে না। দলছুটদের বামপন্থি বলে আখ্যায়িত করা ঠিক হবে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। বামপন্থি তারাই যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে অবিচল থেকে এগিয়ে যায়। সিপিবি সম্পর্কে ধারণা সাধারণত এমনই। জনগণ অন্তত তাই মনে করে যে আমরা আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হইনি। জনগণ বলছে, আমাদের শক্তি কম। আমাদের শক্তি হলে তারা আমাদের সঙ্গে আসবে।
জাগো নিউজ: শক্তি তো জনগণের মধ্য থেকে আসতে হবে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: অবশ্যই। শক্তি এবং জনগণ দুটোই আমাদের প্রয়োজন।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগ-বিএনপি জোটের বাইরেও ইসলামি দলগুলোর শক্তি বাড়ছে। এতে আপনাদের চ্যালেঞ্জ বাড়লো কি না?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: অবশ্যই আমাদের চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। গোটা দেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়লে বামপন্থিরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়।
আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ মানুষের রুটি-রুজির। জাতি আজ বিদেশি স্বার্থের কাছে পদানত। গত ১৬ বছরে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আগামী দুই বছর পর বিদেশি ঋণ শোধ করতে বাজেটের অর্ধেক টাকা চলে যাবে।
রাজনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতা। মানুষের ভোটের অধিকারটাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজনীতির আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিস্তার লাভ করেছে। এই শক্তির ওপর ভর করে ঘাতকের শক্তি রূপ নিয়েছে। এ কারণে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জনগণের নিরাপত্তা হুমকির ওপর পড়েছে। এই শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে।
জাগো নিউজ: কীভাবে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: খণ্ডিতভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথা! সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী ধারা প্রতিষ্ঠা করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মতো আবারও আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। জনগণের জাগরণ ঘটাতে হবে।
জাগো নিউজ: জামায়াত প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করতে চাই। গুঞ্জন আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের বোঝাপড়া হতে পারে। এ নিয়ে আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এই প্রশ্নের পরিপূর্ণ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ রাজনীতির ব্যাকরণ অনুসরণ করে এই বোঝাপড়া হয় না। এটি হয় ব্যবসায়িক ব্যাকরণ অনুসরণ করে। লেনদেনে পোষালে একরকম হবে, নইলে আরেক রকম।
আওয়ামী লীগ এখন চাইছে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। ক্ষমতায় থাকতে পচা-গলা নিকৃষ্ট শক্তিকেও গলায় ঝুলাবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন নির্বাচনে হারলে গাট্টি বোচকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। তাদের জন্য বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এই প্রশ্ন থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে শুধু জামায়াত নয়, আরও খারাপ কোনো শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হতে পারে।
আর জামায়াত তৈরিই হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর পয়সায়। পাকিস্তানের সময় জামায়াত ছিল আইয়ুবের দালাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় নরঘাতক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। জামায়াত দেখছে কার কাঁধে বন্দুক রেখে ফায়ার করলে বেশি সুবিধা। শেষ বলার এখনো সময় আসেনি।
জাগো নিউজ: আপনারা কোনো জোটে যোগ দেওয়ার তাগিদ…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমাদের জোট তো আছেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে আমরা বামপন্থি জোট গঠন করেছি। আরও শক্তি বাইরে রয়েছে। চাইলে তারাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে মত ও আদর্শের ভিত্তিতে। ভাসানী, মোজাফ্ফর আহমেদ, অমল সেন, কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা চুপচাপ বসে আছেন। আমি তাদের জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা একত্রিত হতে পারলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির চেয়েও শক্তিশালী জোট গঠন করতে পারবো।
জাগো নিউজ: আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আপনার বা দলে ভাবনা কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে ভাগবাটোয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কাকে কত আসন দেওয়া হবে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে।
জাগো নিউজ: এই ভাগের কোনো প্রস্তাব পেয়েছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এ প্রস্তাব দেওয়ার মতো কোনো দলের সাহস আছে বলে আমি মনে করি না। বর্তমান শাসক শ্রেণিও জানেন কমিউনিস্ট পার্টিকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ভয় দেখিয়েও দমানো যায় না।
জাগো নিউজ: কিন্তু অনেকেই তো মনে করেন কমিউনিস্ট পার্টিও আওয়ামী লীগের পাহারাদার। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে আপনারাই সুরক্ষা দেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মনে হয়, এটি ডাহা মিথ্যা কথা। আওয়ামী লীগ অনবরত আমাদের ওপর হামলা করছে, গ্রেফতার করছে। আমি নিজে হামলার শিকার।
আওয়ামী লীগ মূলত এমন মিথ্যা রটনা রটিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, এই সরকারের অপসারণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য আমরা লড়াই আরও জোরদার করে তুলবো। তবে এটিই আমাদের একমাত্র ইস্যু নয়। ভাত-কাপড়, ভোটাধিকার, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গদি বদলের চেয়ে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে আমরা বিশ্বাসী। এর জন্য ব্যবস্থার বদল জরুরি। বিজয় আমাদের হবেই।