দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলমান অস্থিরতায় নতুন পাল যোগ করেছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিসহ বেশকিছু সংখ্যক বিরোধীদলের দাবি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর কথা, সংবিধানের বাইরে কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন নয়। এই নিয়ে টানাপোড়েনে বেশ কয়েক বছর ধরেই সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে বিএনপি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের অধীনে কোনো নির্বাচনেই (সংসদ উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার) অংশ নেয়নি বিএনপি। কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে এরই মধ্যে কয়েকটি উপনির্বাচনসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাঁচ সিটি করপোরেশনে দলগতভাবে বিএনপি অংশ না নিলেও দলটির অনেকেই (যাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি) অংশ নেন, যাদের মধ্যে ৩৬ জন বিজয়ী হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রধান দুই দলের এই টানাপোড়েনে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশের আগ্রহের কেন্দ্রে। সবার চাওয়া আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়। এই চাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাও সমান্তরাল। এমনকি সরকারও বলছে, তারাও চায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, চায় সব দল তাতে অংশগ্রহণ করুক। সবার এই অভিন্ন চাওয়া বাস্তবায়নই এখন প্রধান কাজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিস্পৃহতার সুযোগে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে বাইরের দেশগুলোর আগ্রহ বেশি মনে হচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে এমনিতেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত এক দশকের অর্থনৈতিক সাফল্যও বাংলাদেশের প্রতি বাড়িয়েছে অনেকের আগ্রহ। ফলে বাংলাদেশকে ঘিরে এখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নানা মেরুকরণ চলছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে এরই মধ্যে কয়েকটি উপনির্বাচনসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাঁচ সিটি করপোরেশনে দলগতভাবে বিএনপি অংশ না নিলেও দলটির অনেকেই (যাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি) অংশ নেন, যাদের মধ্যে ৩৬ জন বিজয়ী হয়েছেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, সবশেষ পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিএনপির (বহিষ্কৃত) দুইজন মেয়র প্রার্থী অংশ নিয়ে পরাজিত হন। তবে কাউন্সিলর পাদে ১১৯ জন অংশ নিয়ে ৩৬ জন বিজয়ী হন। যাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন: বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন, ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪টি। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৬ ভোট। গাজীপুরে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ২৯ জন অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে বিজয়ী হন ১৩ জন, পরাজিত ১৬। বিএনপি থেকে ২৯ প্রার্থীকেই বহিষ্কার করা হয়েছে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন: আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের সৈয়দ ফয়জুল করিম পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৩৪৫ ভোট। এ সিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোটার। মেয়র পদে বিএনপিপন্থি প্রার্থী ছিলেন একজন। এছাড়া কাউন্সিলর পদে ছিলেন ১৮ জন, যাদের ৯ জন বিজয়ী হন। অবশ্য এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীকেই বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
খুলনা সিটি করপোরেশন: এক লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মো. আ. আউয়াল রহমান পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট। খুলনা সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ৮ জন অংশগ্রহণ করেন। তবে তাদের সবাই পরাজিত হন। বিএনপি থেকে আটজনকেই বহিষ্কার করা হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন: এক লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির মো. নজরুল ইসলাম পান ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। এই সিটিতে মেয়র পদে বিএনপিপন্থি একজন অংশ নেন। এছাড়া কাউন্সিলর পদে অংশ নেন ৩৮ জন। এদের মধ্যে বিজয়ী হন ৮ জন। বিএনপি থেকে ৩৮ প্রার্থীই বহিষ্কৃত হয়েছেন।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন: আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খাইরুজ্জামান লিটন এক লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুরশিদ আলম পেয়েছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। আরেক প্রার্থী লতিফ আনোয়ার পান ১১ হাজার ৭১৩ ভোট। এছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম পান ১০ হাজার ২৭২ ভোট। এই সিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ ভোটার। এই সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ২৬ জন অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে বিজয়ী হন ৬ জন। অবশ্য বিএনপি এসব প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করে।
পাঁচ সিটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও ফলাফল বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবেই মনে করছেন অনেকেই। সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে বলে ধারণা অনেকের।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখন মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে আন্তর্জাতিক মহলের সবার মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কেউ বলছেন না। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনই বিশ্বের অন্য কোনো দেশেও এই ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে বিএনপি অনড় থাকবে, নাকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে- এই প্রশ্ন এখন সবার।
গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যেমন নির্বাচন, তেমনি নির্বাচনকে ফলপ্রসূ করে সবার অংশগ্রহণ। একটি দেশের সব রাজনৈতিক দল যখন নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ আবহে নির্বাচনে অংশ নেয় তখনই তা সফল নির্বাচন বলে গণ্য হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ প্রকাশ করছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে। তবে পাঁচ সিটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও ফলাফল বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবেই মনে করছেন অনেকেই। সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে বলে ধারণা অনেকের। পাঁচ সিটির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন ও জাকের পার্টির অংশগ্রহণ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করেছে বলে দাবি তাদের। এমনকি বরিশালে বিএনপির ছায়া প্রার্থী হিসেবে ছিলেন প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান।
এসব বিষয়ে মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না সে বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করছি না। আমরা বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছি।
তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে কি না- এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করছি না।
ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল শুধু পর্যবেক্ষণ করবে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে কি না। এতে কোন দল অংশগ্রহণ করলো, নাকি করলো না- এ বিষয়ে তাদের মনোযোগ অনেকটাই শিথিল।