সরকার বা সরকারের অধীন অন্য কোনো খাতে সবশেষ কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত কিছুটা শিথিল করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ’ প্রবিধানমালা সংশোধনের খসড়া। মূলত জাগো নিউজে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এ সংশোধনী আনা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে তৈরি করে দেওয়া এ খসড়ায় বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করার পাশাপাশি একজন সিইও কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে সরকার বা সরকারের অধীন অন্য কোনো খাতে সবশেষ কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার পদে কর্মরত ছিলেন, এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রেখে একটি খসড়া প্রবিধানমালা তৈরি করা হয়। এ নিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি ‘যুগ্ম-সচিবও হতে পারবেন বিমা কোম্পানির সিইও!’ শিরোনামে জাগো নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে বিমা খাতে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার পদে কর্মরত ছিলেন- এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রাখার বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা করেন বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ’ প্রবিধানমালার খসড়ায় নতুন করে সংশোধন আনা হয়েছে। এখন যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে সেখানে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন- এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন- এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রেখে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা সংশোধনের খসড়া তৈরি করা হয়। এ নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। সে কারণে ওই বিধান বাতিল করে নতুন করে সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিমা খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত চাওয়া হয়েছে। এখন যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, সেটিই চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
আইডিআরএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার পদে কর্মরত ছিলেন এমন ব্যক্তিদের বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ রেখে তৈরি করা খসড়া প্রবিধানমালার পরিপ্রেক্ষিতে জাগো নিউজে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা বেশ সমালোচনা করেন। মন্ত্রণালয় থেকেও বিধানটি বাতিল করে নতুন করে খসড়া তৈরি করতে বলা হয়। তারই প্রেক্ষিতে সংশোধনীর নতুন খসড়া তৈরি করা হয়েছে।’
এখন বিমা কোম্পানির ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২’ এর সংশোধনীর যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে তাতে বিমা কোম্পানির সিইও’র শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রির অধিকারী। আর গ্রেডিং পদ্ধতির ফলাফলের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে সমতাকরণ সার্টিফিকেট দাখিল করার শর্ত রাখা হয়েছে। তবে কোনো বিমা কোম্পানিতে সিইও হিসেবে কোনো ব্যক্তির নিয়োগের আগে কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন দেওয়া থাকলে তার ক্ষেত্রে উল্লেখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য হবে।
আর কর্ম অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলা হয়েছে, এর আগে কোনো বিমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বা এর অব্যবহিত নিম্নপদে কমপক্ষে দুই বছর কর্ম অভিজ্ঞতাসহ বিমা ব্যবসায় কমপক্ষে ১২ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকবে হবে।
তবে কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) উপযুক্ত মনে করলে দুটি ক্ষেত্রে এ শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিইও পদে নিয়োগ অনুমোদন করতে পারবে। এর মধ্যে প্রথমটি হলা- সরকার বা সরকারি কোনো দপ্তর/সংস্থা/প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোনো বিমা কোম্পানিতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা সরকার বা সরকার সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর/সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের থাকলে।
দ্বিতীয়টি হলো- আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বহুজাতিক বিমা কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা পদে কমপক্ষে ১০ বছরের বিমাবিষয়ক কাজে সরাসরি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দেশের বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রেও আইডিআরএ উপযুক্ত মনে করলে শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সিইও নিয়োগ অনুমোদন করতে পারবে।
বর্তমানে কার্যকর থাকা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ অনুযায়ী, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রিও গ্রহযোগ্য। অর্থাৎ, স্নাতকের ফলাফলের বিষয়ে কোনো সীমা নির্ধারণ নেই। এমনকি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়েও কোনো বক্তব্য নেই। এ প্রবিধানমালায় বিমা কোম্পানির সিইও’র শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি।
অপরদিকে কর্ম অভিজ্ঞতার শর্তে রাখা হয়েছে, একই শ্রেণির বিমা কোম্পানিতে ১৫ বছরে চাকরির অভিজ্ঞতাসহ সিইও অব্যবহিত নিম্নপদে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনো জীবন বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে জীবন বিমা কোম্পানিতেই কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একইভাবে সাধারণ বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে সাধারণ বিমা কোম্পানিতেই কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে বিমাবিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের জন্য অভিজ্ঞতা শর্তসাপেক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিথিল করার বিধান রাখা আছে। আর বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৬৭ বছরের মধ্যে।
এদিকে বিমা কোম্পানির সিইও কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন সে বিষয়ে সংশোধিত খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, মোট বেতন, মূলত বেতন, বাড়িভাড়া এবং অন্যান্যা ভাতা (ভবিষ্য তহবিল, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, বিমা, এক বা একাধিক ইনসেনটিভ বোনাস-এর পরিমাণ বা সীমা নির্দিষ্ট অঙ্কে উল্লেখ থাকতে হবে) সমন্বয়ে গঠিত হবে। এক বছরে মোট ইনসেনটিভ বোনাস ১০ লাখ টাকার বেশি হবে না।
একটি বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, ‘বিমা খাতের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলেকে সিইও করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতা ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে বিধান আছে, সেটিই চালু রাখা উচিত।’
যোগাযোগ করা হলে প্রগতি লাইফের সিইও মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব আছে। এদিক বিবেচনায় কর্ম অভিজ্ঞতা ১৫ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর এবং সিইও’র অব্যবহিত নিম্নপদে কমপক্ষে তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার যে সংশোধনী আনা হচ্ছে, সেটা ঠিক আছে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা মাস্টার্স (স্নাতকোত্তর ডিগ্রি) পাস রাখা উচিত। মাস্টার্স পাস ছাড়া বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।’
তিনি বলন, “কোনো বিমা কোম্পানিতে সিইও হিসেবে কোনো ব্যক্তির নিয়োগ এর আগে কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদ দেওয়া থাকলে তার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য হবে’- এ ধরনের যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটিও সুস্পষ্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হবে তা স্পষ্ট করতে হবে। কারণ বিমা খাতে যে নিয়ম চালু আছে তাতে অষ্টম শ্রেণি পাস একজন পদোন্নতি পেয়ে বিমা কোম্পানির ডিএমডি হতে পারেন। সুতরাং সিইও’র ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু শিথিল হবে তা স্পষ্ট করতে হবে।’’
পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সাবেক সিইও তারিক উর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি বিমা কোম্পানির সিইও হওয়ার ক্ষেত্রে এখন যে নিয়ম চালু আছে, সেটিই ঠিক আছে। নতুন করে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। একজন একটি বিমা কোম্পানির সিইও হবেন, তার অবশ্যই ১৫ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থাকা উচিত এবং সিইও’র অব্যবহিত নিম্নপদে কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকা উচিত।’
আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব আছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই কর্ম অভিজ্ঞতা শিথিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলের কথা বলা থাকলেও কেউ স্নাতক পাস না করে বিমা কোম্পানির সিইও হতে পারবেন না।’