সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে ‘বিচারপতিরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ উল্লেখ করে দেওয়া বক্তব্যের জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা। অন্যদিকে বিচারপতির বক্তব্য সঠিক ও যুক্তিযুক্ত বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা।
এ নিয়ে এরই মধ্যে বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষাভ সমাবেশ হয়েছে। যে কোনো মামলার শুনানি ও আলাপ আলোচনায় সেই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টানার চেষ্টা করছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। বিচারপতির দেওয়া বক্তব্য নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত আইনজীবীরা।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে এবং ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ব্যানারে সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠান হয়েছে। যে যার পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরছেন।
ওই বক্তব্যের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবি করেছেন বিএনপি ও বামপন্থি রাজনীনিতিবিদ ও সিনিয়র আইনজীবীরা। তারা বলছেন, তাদের (বিচারপতি) এখন খায়েশ হয়েছে রাজনীতি করার। আর সেই রাজনীতি হলো দলীয় রাজনীতি।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেছেন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এমন বিষয় নিয়ে বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবি করে জনগণকে ন্যায়বিচারবঞ্চিত করে সুপ্রিম কোর্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
বারের সভাপতি বলেন, সমিতির অনুমতি না নিয়ে বারের হলরুমে সংবাদ সম্মেলন করে বিচারকদের পদত্যাগ দাবিকারীরা আদালত অবমানা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের আবেদন করা হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বারের সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, আজ যা দেখছি তাতে বিচার বিভাগ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। সারাদেশ সর্বোচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা যদি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান তাহলে সেখানে রাজনীতিও থাকে না, বিচার ব্যবস্থাও থাকে না। আইনের শাসন বলতেও কিছু থাকে না।
বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জাগো নিউজকে বলেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ বলা বিচারকদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। তারা যদি বিচার করেন, সেটি বিচার হবে না। তা বিচারের নামে অবিচার হবে।
তিনি বলেন, এখানে বিচারপতির বক্তব্য কতটুকু বিচারকসুলভ হয়েছে, তারা বিচারপতির মহত্ব ধারণ করতে পারেন কি না, তা নিয়ে অনেক সংশয় ও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বস্তুতপক্ষে একজন রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতিফলন হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট যেন একটি রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হচ্ছে। এটি আমাদের খুবই ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর যদি আমরা দেখি বিচারপতিরা অতিউৎসাহী হয়ে আচার আচরণে রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে আসছেন, তাতে শুধু আইনজীবীরা নন, জনগণের মধ্যেও একটি শঙ্কার সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে হচ্ছেও।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, পুলিশ ভাইয়েরা তাদের আচরণের মাধ্যমে যেভাবে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন, আমাদের বিচার বিভাগও যদি এ ধরনের রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যায় তাহলে আমাদের সামনে বাংলাদেশের জন্য সামগ্রিকভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের মধ্যে আমরা পড়ে যাচ্ছি।
তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা, অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন ভিন্ন কথা। বিচারপতির ওই বক্তব্যে তিনি কোনো অসুবিধা দেখেন না।
অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, স্পষ্টভাবে একটা জিনিস বলতে চাই, উনি (আপিল বিভাগের বিচারপতি) যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটা তাদের (বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা) পুরোটা শুনতে হবে। উনি কথাটা কোন প্রেক্ষাপটে বলেছেন, যে আমরা সংবিধানের সংরক্ষক। আমরা আইনের হেফাজতকারী। আমরা এ দায়িত্বটা নেই শপথ গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, উনার কথা নিয়ে আজ যারা প্রতিবাদ করছেন, আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তারা যদি সাধারণ কোনো মানুষ হতেন তাহলে হয়তো বুঝতাম যে তারা বোঝেন না। যারা আলোচনা করছেন তারা সবাই সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী। আইন পেশায় নিয়োজিত। তারা অবশ্যই জানেন বক্তব্যটা কোন প্রেক্ষিতে, কেন বলেছেন। তারা পুরো বক্তব্য না শুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলছেন এবং রাজনীতি করছেন। তারা চেষ্টা করছেন আদালত অঙ্গনের পরিবেশটা বিনষ্ট করার।
সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে কী আছে? জনগণ হচ্ছে সব ক্ষমতার অধিকারী। আপনি দেখেন, উনি যে কথা বলেছেন, সংবিধান সংরক্ষণকারী। পঞ্চম সংশোধনী যেটা সামরিক ফরমানের পরিবর্তন হয়েছিল, সেটা কিন্তু আমাদের আদালত এই সুপ্রিম কোর্ট, সেটা বাতিল করে দিয়েছে। সপ্তম সংশোধনী দেখেন, সেটাও এই সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে উনার কথাটা কি সঠিক হলো না? আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি সেই মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থি কিছু হলে আদালত দেখবে। এটা আদালতের ওপর অর্পিত দায়িত্ব।
বিচারকের পদত্যাগ চেয়ে সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা বিচারপতিদের নিয়ে কথা বলেন বা পদত্যাগ চান তারা চাচ্ছেন না দেশের সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাক। উনারা চাচ্ছেন না বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলুক বা পরিচালিত হোক। উনারা চাচ্ছেন একটা সমস্যা সৃষ্টি করে অসাংবিধানিকভাবে কোনো কিছু করার। হয়তো এ কারণে উনারা এরকম করছেন।
এ বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, সংবিধানের মূল কথা কিন্তু এটাই, যেটা গত ১৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি তার বক্তৃতায় বলেছেন। তিনি সঠিক কথা বলেছেন। কারণ সংবিধান রক্ষা করতে হলে তাদের প্রত্যেক বিচারপতিকে সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারে কোনো মিটিং করতে হলে আইনজীবী সমিতির (বার অ্যাসোশিয়েশনের) অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু কোনো পারমিশন ছাড়াই কিছু দিন আগে জামায়াত অধ্যুষিত বিএনপি ও অন্যান্য কিছু কিছু ল’ইয়ার একটা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এটা বারের জন্য খুবই খারাপ নজির।
তিনি বলেন, উনি রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। উনি সংবিধানের দেওয়া অঙ্গীকার যেটা আছে, যে শপথ নিয়েছেন, সেই শপথের আলোকে বলেছেন ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’। কোনো দলের বা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বক্তব্য দেননি।
আদালত অবমানার অভিযোগ তোলার বিষয়ে জয়নুল আবেদীন বলেন, অভিযোগ করবেন কেন? আপনারা এই (আমাদের) কাতারে চলে আসুন। যদি বিচার বিভাগকে ভালোবাসেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চান তাহলে এসব চিন্তা মাথা থেকে ছেড়ে দেন।
আদালত অবমাননার অভিযোগ তোলার বিষয়ে বিএনপির আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, আদালত অবমাননার অভিযোগে বিচার হবে। আমরা অতীতেও এ অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে, বিবেকের প্রশ্নে, দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এমন অভিযোগ নিয়ে উই আর রেডি টু…।
যে বক্তব্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি কথাবার্তা:
১৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত শোক দিবস-২০২৩ এর আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহীম বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে তার জন্ম শতবার্ষিকী পালন করেছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষ, এদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আমরা বিচারকরা, এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এ জন্ম শত বছর পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক নিয়ে নানান লেখা রাখা হয়েছে, তার দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সংগ্রামী দিক, ব্যক্তিগত দিক, পারিবারিক দিক- এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু ইদানীং আমার কাছে মনে হয়, আমরা বঙ্গবন্ধুকে যত বেশি না আলোচনা করছি, বঙ্গবন্ধুর চর্চাটা বোধহয় সেখানে একেবারেই কম হচ্ছে। আমি মনে করি যে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে আলোচনা যথেষ্ট আমরা করেছি। যথেষ্টই হবে। কিন্তু এর সিকিভাগ চর্চা বোধহয় আমাদের জীবনে প্রয়োজন। আমরা যে যেখানে যে দায়িত্ব পালন করছি, সে দায়িত্ব থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর চর্চাটা করি আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে। তখনই আমি বলতে পারবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চর্চাটি করছি।
তিনি বলেন, আবার অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন, ভাবতে পারেন আমাদের অতীতের পরিচয় আছে, বর্তমানের পরিচয় আছে, ভবিষ্যতের পরিচয়- সব কিছুই থাকতে পারে। কিন্তু আমি যখন বিচারক হিসেবে শপথবদ্ধ হয়েছি, সব সময় একটা বিষয় মনে রাখতে হয়, যে আমার জুরিশডিকশনটা কী? আমি কতটুকু করতে পারি? আমি কি বলতে পারবো? কারণ এখানে প্রশ্ন উঠেছে ওমুক বিষয়টা বিচার করা যাবে না। মাননীয় প্রধান বিচারপাতি কেন নির্দেশনা দেবেন না।
বিচারপতি প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমরা বিচারপতিরা কোনো বিষয়ে কতটুকু দাবি তুলতে পারি? কোনো বিষয়ে কতটুকু কথা বলতে পারি? আমার মনে হয় এ বিষয়গুলো আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। আমরা দেশের বিপ্লব ঘটাতে পারবো না। আমাদের মনে যত আকাঙ্ক্ষাই থাক না কেন, আমি যে শপথ নিয়েছি। এই শপথের মধ্যে থেকেই আমাকে কাজ করতে হবে। এই শপথকেই বলি, আমি বিগত সময়ে একটি বারের অনুষ্ঠানে বলেছিলাম যে আমাদের বাংলাদেশে রাজনীতিবিদরা আজকে কেউ বিএনপি করতে পারেন, দলবদল করে আওয়ামী লীগে আসেন, আওয়ামী লীগের লোক আরেক দলে চলে যান। আরেক দলের লোক আরেক দলে চলে যান। কিন্তু আমি বিচারপতি যখন একটি শপথবাক্য পাঠ করি, এই সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি প্রায় সময়ই বলি, বার বার বলি, সুযোগ পেলেই বলি যে, ‘আমরা বাংলাদেশের বিচারপতিরা, আমরা হলাম শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ।
তিনি বলেন, এই যে সংবিধান, এই সংবিধান হলো আমাদের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দলিল। এই সংবিধান কোনো খয়রাতি বিষয় ছিল না। এ সংবিধান আনতে গিয়ে এই দেশের মানুষকে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে, লড়াই করতে হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর যে রাষ্ট্রদর্শন, বঙ্গবন্ধুর যে রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক দর্শন সব দর্শনে এর প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের এই সংবিধানে। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে আমাদের সংবিধানকে কাটাছেড়া করা হয়েছিল।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহীম বলেন, আমাদের বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট অনেকবার এই ভুলটুকু করেছিল। এই প্রেক্ষাপটগুলো বিবেচনায় না নিয়ে। আামি বলবো আমরা বিচারক। যারা এ অঙ্গনে আছি, আমরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ হিসেবে, আমরা মনে করি যে আমাদের সংবিধান রক্ষা করতে হবে।