# অনিবন্ধিত ও অন্য কোম্পানির প্যাকেট নকল করে চলছে চা বাজারজাত
# নিলাম ছাড়াই ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে পঞ্চগড়ের চা আসে চট্টগ্রামে
বিধি মোতাবেক সরকারি অকশন ছাড়া বাগানে উৎপাদিত চা বাজারে যাওয়ার কথা নয়। অকশন পরবর্তী বাজারজাত হওয়ার ক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগ যেমন ভ্যাট পেয়ে থাকে, তেমনি চা বোর্ড অকশন হওয়া চায়ের ১ শতাংশ হারে আয় করে। কিন্তু অকশনবহির্ভূত অবৈধ চা বাজারজাত করার ফলে দুদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আবার অবৈধভাবে চা বাজারজাতকরণে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি উৎপাদন তথ্যেও গড়মিল হচ্ছে। সম্প্রতি চা বোর্ড পঞ্চগড় ও চট্টগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গেলে এসব অনিয়ম ধরা পড়ে।
শুধু তাই নয়, অকশন ছাড়া এসব চা বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের প্যাকেট নকল ও অনুকরণ করে প্যাকেটজাত হয়ে বাজারজাত হচ্ছে। এতে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে ভ্যাটের পুরো অংশ। এছাড়া আইন থাকলেও নেওয়া হচ্ছে না চা বোর্ডের লাইসেন্সও। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ছাড়পত্র না নিয়ে চায়ের প্যাকেটে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটির লোগোও।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন— বর্তমানে যত চা উৎপাদনের তথ্য দেখানো হচ্ছে, বস্তুত তার চেয়ে বেশি চা উৎপাদিত হচ্ছে দেশের চা-বাগানগুলোতে। অকশনের আওতাভুক্ত না হওয়ায় সরকারি তথ্যে যুক্ত হচ্ছে না অবৈধভাবে বাজারজাত হওয়া চা। এ অকশনের বাইরের অংশটি অবৈধভাবে বাজারজাত হয়ে আসছে সারাদেশে। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে নজরদারি না থাকায় সারাদেশে গড়ে উঠেছে অবৈধ চায়ের কারবারের শক্ত সিন্ডিকেট।
চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানার আদালতপাড়া। এখানে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ আইনি সেবা নিতে আসেন। কোর্ট হিলে আসা লোকজনকে টার্গেট করে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি কোর্ট হিলের পাহাড়ে নানা নামে প্যাকেটজাত চা বিক্রি শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের কোর্ট হিলে ‘বেস্ট টি প্রিমিয়াম’, ‘মিম সুপার গোল্ড টি’, ‘সিলেটার গোল্ড টি’, ‘শ্রীমঙ্গল গোল্ড টি’, ‘শেভরন গোল্ড টি’, ‘মিয়াজিপুরি ব্ল্যাক টি’সহ নানান নামের চা বিক্রি করছেন ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে সবগুলো ব্র্যান্ডের চায়ের প্যাকেট। প্রত্যেক প্যাকেটেই রয়েছে বিএসটিআইয়ের লোগো লাগানো।
এখানকার খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক পাইকারি চা বিক্রেতারা এসব প্যাকেটজাত চা তাদের সরবরাহ করেন। বেশি লাভের আশায় তারাও এসব চা বিক্রি করছেন। প্রতি কেজি ২৪০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয় এসব চা।
চট্টগ্রামের কোর্ট হিলে বিক্রি হওয়া চায়ের মধ্যে বেস্ট টি প্রিমিয়াম নামের প্যাকেটের গায়ে ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড প্যাকেজিং আর কে গ্রুপ, স্টেশন রোড, মৌলভীবাজার, সিলেট লেখা। মিম সুপার গোল্ড টি প্যাকেটের গায়ে ব্ল্যাক টি ৫০০ গ্রাম, প্রস্তুতকারক নিজাম টি হাউজ, ৩৭ অলি মিয়া লেন, চাক্তাই, চট্টগ্রাম লেখা আছে।
সিলেটার গোল্ড টি প্যাকেটের গায়ে ম্যানুফ্যাকচার্ড বাই শাহজালাল ফুড প্রোডাক্টস, ঢাকা, বাংলাদেশ লেখা। শ্রীমঙ্গল গোল্ড টি’র প্যাকেটের গায়ে বাজারজাতকারী শাহজালাল টি হাউজ, বাংলাদেশ লেখা। আবার শেভরন গোল্ড টি’র প্যাকেটের গায়ে প্যাকড অ্যান্ড মার্কেটেড বাই শাহজালাল টি কোম্পানি, শ্রীমঙ্গল, সিলেট লেখা। একইভাবে মিয়াজিপুরি ব্ল্যাক টি’র প্যাকেটে বাজারজাতকারক শাহ্জালাল ফুড প্রোডাক্টস, চট্টগ্রাম-বাংলাদেশ লেখা।
মিম সুপার গোল্ড টি’র প্যাকেটের গায়ে লেখা ঠিকানার সূত্র ধরে শনিবার দুপুরে ৩৭ অলি মিয়া লেন, চাক্তাইয়ের ঠিকানায় গিয়ে মেসার্স নিজাম হাউজ নামে প্রতিষ্ঠানটির সত্যতা পাওয়া যায়। এটি একটি চাপাতার পাইকারি দোকান। এসময় পাশের ৩৬ অলি মিয়া লেনের ঠিকানায় দেখা যায় মেসার্স শাহজালাল টি হাউজের নাম। পরে সাইনবোর্ড থেকে নেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে কথা হয় মেসার্স নিজাম টি হাউজের স্বত্বাধিকারী মো. নিজামের সঙ্গে। মিম সুপার গোল্ড টি নামের চা প্যাকেটটি তাদের বলে স্বীকার করেন। এসময় প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে তিনি পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন। পরে তিনি ফোন করে চা প্যাকেট করার চা বোর্ডের অনুমোদন ও বিএসটিআই লাইসেন্স রয়েছে বলে দাবি করেন।
এরপর ফোনে কথা হয় মেসার্স শাহজালাল টি হাউজের মালিক জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা কোনো চা প্যাকেট করে বিক্রি করি না। বিভিন্ন সরবরাহকারীর কাছ থেকে বস্তায় চা কিনে বিক্রি করি। চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় বিক্রি হওয়া চায়ের মধ্যে কোনোটি তাদের নয় বলে দাবি করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের সিলেট, মৌলভীবাজার অঞ্চল থেকে কিছু এবং পঞ্চগড় এলাকা থেকে বড় অংশ চা অকশনের বাইরে বাজারজাত হয়ে আসছে। অবৈধ ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন রংচঙা নাম দিয়ে প্যাকেটজাত করে এসব চা বাজারজাত করছে। এতে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছেন অবৈধ চায়ের কারবারিরা।
সম্প্রতি পঞ্চগড় ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে চা বাজারজাত করার অপরাধে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মাদ রুহুল আমীন। গত ২০ আগস্ট পঞ্চগড় সদর উপজেলার মৈত্রী টি ইন্ডাস্ট্রিজকে ৫০ হাজার টাকা, উত্তরা গ্রীন টি ইন্ডাস্ট্রিজকে ৫০ হাজার, নর্থবেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজকে ৫০ হাজার, ২১ আগস্ট মীরপুরি চা’কে ৫০ হাজার এবং মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। চা বাজারজাতকরণের বৈধ লাইসেন্স না থাকা, নকল ট্রেডমার্ক ও মূসক চালান ব্যবহার করে ভ্যাট ফাঁকি ও কালোবাজার থেকে চা কেনার অপরাধে এ জরিমানা করা হয় বলে জানিয়েছে চা বোর্ড।
সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর এলাকার একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে চা ব্যবসার বৈধ লাইসেন্স না থাকা, নিলামবহির্ভূত চা ক্রয়, অবৈধ ট্রেডমার্ক ব্যবহার এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চা প্যাকেটজাতের অপরাধে রাজধানী ফুড প্রোডাক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় অকশনবহির্ভূতভাবে কেনা প্রতিষ্ঠানটির ১০ হাজার কেজি চা জব্দ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এসব অভিযানে অবৈধ চায়ের কারবারে জড়িতদের রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজরে আসে। চা বোর্ডের অভিযান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অকশনবহির্ভূত চা বাজারজাত করার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা নানান প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠি ব্র্যান্ডের চা প্যাকেটের আদলে প্যাকেট বানিয়ে বিভিন্ন নামে চা বাজারজাত করছেন। অনেক ব্যবসায়ী নিজেরা ভ্যাট চালানের বই ছাপিয়ে ব্যবহার করছেন। চায়ের ক্রেতাদের ভ্যাট চালানের কপি দেওয়া হলেও মূলত ভ্যাট প্রশাসনের কাছে কোনো ভ্যাট জমা দেয় না প্রতিষ্ঠানগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের এক উপপরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাটের মূসক (মূল্য সংযোজন কর) ফরম নিজেরাই (কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজন ছাড়া) ছাপাতে পারেন। তবে, ক্রেতা ভোক্তাদের যে পরিমাণ মূসক দিচ্ছেন, তত টাকা ভ্যাট কমিশনারেটের নির্ধারিত ব্যাংক হিসেবে চালানমূলে জমা দিতে হবে। এতে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ মিললে দ্বিগুণ জরিমানা ও মামলার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, এতদিন পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম (অকশন) কেন্দ্র ছিল না। চট্টগ্রাম এবং সিলেটে চা নিলাম হতো। চা বোর্ডের হিসাব মতে, দেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানগুলোতে ২০২২ সালে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৬০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এখানে চায়ের একটি বড় অংশ অকশনবহির্ভূতভাবে কালোবাজারে বিক্রি হয়। তাতে চা উৎপাদনের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান করা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের এসব জেলায় প্রায় ৩ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়। কিন্তু অকশনবহির্ভূতভাবে কেনাবেচা হওয়ায় চা-বোর্ডের রিপোর্টে এ তথ্য আসে না। অকশনবহির্ভূত চায়ের বড় অংশ চলে আসে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, পাহাড়তলী ও রিয়াজ উদ্দিন বাজারে।
এ বিষয়ে চা বোর্ডের উপ-সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মাদ রুহুল আমীন জাগো নিউজকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা চা বাজারজাতকরণে নানান অনিয়ম দেখেছি। অনেকেই অকশন ছাড়া চা কেনাবেচা করছেন। ভুয়া ব্র্যান্ড বানিয়ে করে চা প্যাকেটজাত হচ্ছে। আবার এক ডিজাইনের প্যাকেট অনুমোদন নিয়ে আরেক ডিজাইনের প্যাকেটজাত করে চা বিক্রি হচ্ছে। চা আইন অনুযায়ী কারখানার নিবন্ধন, চা বোর্ডের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি চা প্যাকেটজাত করার প্যাকেটগুলোর নির্ধারিত ডিজাইন অনুমোদনও বাধ্যতামূলক। এখানে অনেকে চা বোর্ডের কোনো অনুমতি না নিয়ে চা বাজারজাত করছেন। পাশাপাশি অবৈধ চা বাজারজাত করতে বেআইনিভাবে বিএসটিআইয়ের লোগোও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পঞ্চগড়ে অনেক চা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে মূসক ফরম ও রেজিস্ট্রার পাওয়া গেছে। তবে ভ্যাট পরিশোধের কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি। চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, তারা ১৪ ডিজাইনের প্যাকেটে বাহারি নাম দিয়ে চা প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করছেন। আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের জরিমানা করেছি। একই অপরাধ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আগামীতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা যায়, ১৯৭৭ সালে চা অধ্যাদেশ-১৯৭৭ এর অধীনে বাংলাদেশ চা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালে চা আইন জারির পর আগের অধ্যাদেশ রহিত করা হয়। বর্তমানে চা আইন-২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ চা বোর্ড পরিচালিত হচ্ছে। এ আইন প্রণয়নের পর প্রথমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে চা বোর্ড।
চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও পঞ্চগড়সহ দেশের সাত জেলায় চায়ের আবাদ হচ্ছে। এসব জেলায় ১৬৮টি চা-বাগান ও সমতলে ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানে চা চাষ হয়। ২০২২ সালে ১ লাখ ৬৪ হাজার একর জমিতে চায়ের আবাদ হয়। তাতে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়। বাগান থেকে চা-পাতা তুলে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে দানাদার চা তৈরির পর তা অকশনের মাধ্যমে বিক্রি করতে হয়। চলতি বছর ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এরই মধ্যে বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪ কোটি ৯৬ হাজার কেজি উৎপাদিত হয়েছে।