এক দফার আন্দোলনে ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবীদের পৃথক মোর্চা গড়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। সামনে সরকার হটানোর চূড়ান্ত আন্দোলনে এই তিন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ আরও দৃশ্যমান করাই এর লক্ষ্য। দলটির নেতারা মনে করছেন, সরকারবিরোধী সব ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন এবং পেশাজীবীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো না গেলে গণ-অভ্যুত্থান পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না।
আন্দোলন যুগপৎ হলেও বিএনপির একক সিদ্ধান্তে কর্মসূচি, শরিকেরা অসন্তুষ্ট
এ লক্ষ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ নামে একটি আলাদা মোর্চা গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রদলসহ ১৯টি ছাত্রসংগঠনের মতবিনিময় বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার’সহ জাতীয় স্বার্থে তারা একত্রে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলোর একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁদের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ওই বৈঠকে ছাত্র ঐক্যের ভিত্তি নির্ধারণ করাসহ এর ভবিষ্যৎ পথচলার বিষয়ে একটি যৌথ ঘোষণা আসতে পারে। তবে ওই বৈঠকের সময় এবং সাংগঠনিক কর্মকৌশল কী হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ১৯টি সংগঠন মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছে। আরও কিছু সংগঠনের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। আশা করি শিগগিরই ছাত্রদের একটি বৃহত্তর মঞ্চ হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক ছাত্রসংগঠনের দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ এবং যুগপৎ—দুই পন্থায় আন্দোলন কর্মসূচির চিন্তা করছেন। কারণ, সব ছাত্রসংগঠন সবার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে। সে জন্য কিছু সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে, আর কিছু সংগঠন যুগপৎভাবে কর্মসূচি করতে পারে। কিন্তু সবার আপাত লক্ষ্য, সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন। একই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং সহাবস্থানের রাজনীতি নিশ্চিত করা।
আন্দোলন সফল করার কৌশল ঠিক করতে পরামর্শ বিএনপির তৃণমূলের
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ১৯টি সংগঠন মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছে। আরও কিছু সংগঠনের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। আশা করি শিগগিরই ছাত্রদের একটি বৃহত্তর মঞ্চ হবে।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাখা হয়নি!
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে যেমন ডাকা হয়নি, তেমনি ছাত্রদলের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রক্রিয়ায় ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও যুক্ত করা হয়নি। তবে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এ ধরনের যোগাযোগের কথা কোনো পক্ষই স্বীকার করেনি।
আপাতত ১৯ ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত রোববার ছাত্রদলের আহ্বানে অনুষ্ঠিত ছাত্র ঐক্যের বৈঠকে চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন অংশ নিয়েছে। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। কারণ, ইসলামী আন্দোলন বিএনপির সঙ্গে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে নেই।
আমরা মনে করি, ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ভোটের অধিকার তো কোনো আদর্শিক দাবি নয়। এ ক্ষেত্রে একত্রে বা যুগপৎভাবে কাজ করলে আদর্শের বিচ্যুতি হবে না। তাই জাতির এই সংকটে সব দল, মত ও আদর্শের মানুষের এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করা উচিত।
এ ছাড়া ছাত্রদলের ডাকে বৈঠকে অংশ নিয়েছে নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি আন্দোলন), নাগরিক ছাত্র ঐক্য (মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (আ স ম রবের জেএসডি), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাগপা), ছাত্র মিশন (লেবার পার্টি), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ (মুফতি ওয়াক্কাস), ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম), ভাসানী ছাত্র পরিষদ (ভাসানী অনুসারী পরিষদ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন (এনডিএম), ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্রসমাজ (বিজেপি), খেলাফত ছাত্র মজলিস (মাওলানা মামুনুল হকের দলের ছাত্রসংগঠন), বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস (শায়খুল হাদিস আজিজুল হক), বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ (নেজামে ইসলাম পার্টি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি) ও জাতীয় ছাত্রসমাজ (কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি)। এসব ছাত্রসংগঠনের মূল দলগুলোর অধিকাংশই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে।
গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি মোর্চা করার চেষ্টায় আছি।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ভোটের অধিকার তো কোনো আদর্শিক দাবি নয়। এ ক্ষেত্রে একত্রে বা যুগপৎভাবে কাজ করলে আদর্শের বিচ্যুতি হবে না। তাই জাতির এই সংকটে সব দল, মত ও আদর্শের মানুষের এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করা উচিত।’
শ্রমিক দল সক্রিয়, দৃষ্টি স্কপে
চলমান আন্দোলনে ছাত্রদলের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলকে সক্রিয় করেছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে শ্রমিকশ্রেণির অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। ইতিমধ্যে শ্রমিক দল চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে শ্রমিক সমাবেশ ও পদযাত্রা করেছে। সামনের আন্দোলন-কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে শ্রমিক দলকে সংগঠিত করা হচ্ছে। এর জন্য শ্রমিকনেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সিটি ভোট বর্জন, আন্দোলন, দুটোতেই জোর বিএনপির
জানা গেছে, শ্রমিক দলের পাশাপাশি এখন বিএনপির দৃষ্টি শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) দিকে। শ্রমিক দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, স্কপকে তারা সক্রিয় করার চেষ্টা করছে। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমশক্তির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)। ১৬টি শ্রমিক ইউনিয়নের জাতীয় ফেডারেশন স্কপে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বাম দলগুলোর শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এই সময়ে স্কপ আর নীরব না থেকে শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের ন্যায্য দাবিদাওয়াগুলো আদায়ে রাজপথে সক্রিয় হোক, সেটি চায় শ্রমিক দল।
শ্রমিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতিমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনুযায়ী শ্রমিকদের মহার্ঘ ভাতা প্রদান, ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা, মজুরি কমিশনের ঘোষণা না দেওয়া, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সংকুচিত করাসহ নানা কারণে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। স্কপ সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনে যুক্ত হবে না। তবে বিএনপির শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক দল চাইছে, স্কপ যাতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকে।
শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে একটি মোর্চা করার চেষ্টায় আছি।’
ঢাকায় পেশাজীবী মহাসমাবেশের পরিকল্পনা
ছাত্র ও শ্রমিকদের পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে বিএনপিপন্থী পেশাজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের সঙ্গে নেই, এমন বিরোধী দলের পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছে। ইতিমধ্যে ইউনাইটেড ল ইয়ার্স ফ্রন্ট নামে সরকারবিরোধী আইনজীবীদের একটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে হয়েছে।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব কাদের গণি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশের পেশাজীবীদের এক শামিয়ানায় আনার চেষ্টা করছি। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাংবাদিক, কৃষিবিদসহ অন্যান্য পেশাজীবীকে নিয়ে ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।’