বুধবার , ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. উপ-সম্পাদকীয়
  5. কৃষি ও প্রকৃতি
  6. ক্যাম্পাস
  7. খেলাধুলা
  8. চাকরি
  9. জাতীয়
  10. জীবনযাপন
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দেশগ্রাম
  13. দেশজুড়ে
  14. ধর্ম
  15. নারী ও শিশু

চট্টগ্রাম হালদা ভ্যালি চা বাগানের কবজায় ৭৮৫ একর সরকারি জমি

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩ ৪:৩৬ অপরাহ্ণ

# চা বাগানের নামে সরকারি এসব জায়গা দখল করে আছে হালদা ভ্যালি
# খনন করা হয়েছে লেক, করা হয়েছে ফলের বাগান
# জেলা প্রশাসনের মামলায় ৮ মাসেও হয়নি পুলিশি প্রতিবেদন

সরকারি ৭৮৫ একর জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি লিমিটেডের নামে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, ফটিকছড়ি উপজেলার বাদুরখীল মৌজায় এসব জায়গা দখল করে আছে হালদা ভ্যালি। বিষয়টি অবগত করে গত ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। দখল করা জায়গায় লেক ও বাগান করায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আসামি করে মামলা করা হলেও আট মাসে কোনো অগ্রগতি নেই।

জেলা প্রশাসন বলছেন, অবৈধভাবে দখল করা জায়গায় টিলার পাদদেশে খনন করা হয়েছে লেক। চায়ের পাশাপাশি করা হয়েছে ড্রাগন ফল, কমলা ও নারিকেলের বাগান। লেক খননের ঘটনায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হালদা ভ্যালি টি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আসামি করে থানায় মামলা হলেও আট মাসেও ওই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি থানা পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর অলিখিত নির্দেশনার কারণে অবৈধভাবে দখলে থাকা সরকারি এসব সম্পত্তি উদ্ধারে এগোতে পারছে না প্রশাসন। তবে কোন মন্ত্রী এবং কী তার নির্দেশনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কেউ মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

জানা যায়, স্থানীয় জনগণের মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জানুয়ারি হালদা ভ্যালি চা বাগানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাব্বির রাহমান সানি। অভিযান চলাকালীন চা-বাগানের অভ্যন্তরে বাদুরখীল মৌজায় অবৈধ লেক খননের প্রমাণ মেলে। এসময় অবৈধ লেক খনন করায় বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ মোতাবেক বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মহসিন হোসেনকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। একই আইনে এক্সেভেটর চালক গৌতম দাশকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এসময় বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঘটনাস্থলে না থাকায় তার বিরুদ্ধে স্থানীয় নারায়ণহাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আবু বক্কর বাদী হয়ে স্থানীয় ভূজপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খানকে একমাত্র আসামি করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন ফারুকী নিজেই মামলাটির তদন্তভার নেন। কিন্তু দীর্ঘ আটমাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ওই মামলায় প্রতিবেদন দিতে পারেননি তিনি।

ভূজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন ফারুকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মামলার প্রতিবেদন এখনো দেইনি। তবে তদন্তে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে এবং এতে বেশিদিন সময় লাগবে না।’

মামলার এজাহারের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সত্যতা মিলেছে এমন বলা যাবে না। এজন্যই প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে।’

তবে সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘থানা পুলিশ ফৌজদারি অপরাধ দেখভাল করে। জায়গা সম্পত্তি দখল-বেদখল সিভিল ম্যাটার। যেহেতু সরকারি সম্পত্তি, সেহেতু এসব সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যদি আমাদের কাছে কোনো সহযোগিতা চান, তাহলে আমরা সহযোগিতা দেবো।’

মামলাটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হালদা ভ্যালির মামলাটি নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেদিন হালদা ভ্যালির মামলা হয়েছে, একইদিন একই ঘটনায় মোবাইল কোর্টও হয়েছে। মোবাইল কোর্টে দুজনকে সাজা দেওয়া হয়। একই ঘটনায় দুটি মামলা চলতে পারে না।’

বাদী আবু বক্কর জাগো নিউজকে বলেন, ‘হালদা ভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে আমরা মামলাটি করেছি ২৯ জানুয়ারি। মামলাটি ওসি সাহেব নিজেই তদন্ত করছেন। কিন্তু গত আট মাসে তদন্ত কর্মকর্তা আমার সঙ্গে একবারও কথা বলেননি। এজাহার পরবর্তী আমার কোনো জবানবন্দিও নেননি।’

jagonews24

এদিকে মামলার পরের সপ্তাহে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর লেখা ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাব্বির রাহমান সানি স্বাক্ষরিত এক পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘হালদা ভ্যালি চা বাগানের নামে ইতোপূর্বে ইজারা দেওয়া ১০৫২ দশমিক ৬৯ একর জমির বাইরেও বাগান কর্তৃপক্ষ বাদুরখীল মৌজার বিএস ২০০, ৪১৪ এবং ৬০১ দাগে মোট আরও ৭৮৪ দশমিক ৭৩ একর খাস খতিয়ানভুক্ত জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। ফটিকছড়ি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) দাখিল করা প্রতিবেদনে জায়গা পরিমাপকালীন ওই জমিতে চা বাগান, ড্রাগন ফলের বাগান, মাল্টা বাগান, সুপারি বাগান, জৈব সার তৈরির ফ্যাক্টরি, আবাসিক বাংলো এবং লেক সৃজন করা হয়েছে বলে দেখতে পান।’

ওই চিঠির তথ্য অনুযায়ী, অবৈধভাবে দখল করা ৭৮৪ দশমিক ৭৩ একর জায়গার মধ্যে ৫২১ দশমিক ১৮ একর চা বাগান, ৭ দশমিক ৫ একর ড্রাগন বাগান, ২১ দশমিক ১ একর মাল্টা বাগান, ১ একর সুপারি বাগান, ২ দশমিক ৩ একর নতুন খননকৃত লেক, ৫ দশমিক ৪ একর জৈব সার ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স, ২ দশমিক ২৫ একর আবাসিক বাংলো ও ২২৪ একর খালি জমি রয়েছে।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাব্বির রাহমান সানি জাগো নিউজকে বলেন, ‘৭৮৪ একর সরকারি জায়গা দখল ও লেক খনন করার অপরাধে হালদা ভ্যালির রিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন।’

ফটিকছটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার চিঠির পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। ওই চিঠিতে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘ফটিকছড়ি উপজেলার চান্দপুর, শৈলকুপা, বাদুরখীল, ইদিলপুর ও লট-১৭ বি ইদিলপুর মৌজার মোট ১০৫২ দশমিক ৬৯ একর জমি হালদা ভ্যালি চা বাগানের অনুকূলে লিজ দেওয়া হয়েছে। লিজের জমির বাইরে হালদা ভ্যালি চা বাগান কর্তৃপক্ষ বাদুরখীল মৌজায় বিএস ২০০, ৪১৪, ৬০১ দাগের ৭৮৪ দশমিক ৭৩ একর জমি অবৈধভাবে দখলে রয়েছে। অবৈধভাবে দখল করা জায়গায় টিলার পাদদেশে অবৈধভাবে একটি লেক খনন করা হয়েছে।’

প্রতিবেদনটির আরেক অংশে উল্লেখ করা হয়, হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি লি. লিজভুক্ত জমির বাইরে প্রায় ৭৮৪ দশমিক ৭৩ একর জমি অবৈধভাবে দখল ও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, যা চা বাগানের ভূমি ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা’২০১৭ এর ১১.৩ অনুচ্ছেদ এর পরিপন্থি। এছাড়া উক্ত বাগানে চা চাষের পাশাপাশি ড্রাগন ফল, কমলা ও নারিকেলের বাগান করা হয়েছে, যা চা বাগানের ভূমি ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা’ ২০১৭ এর ১১.২ অনুচ্ছেদ এর পরিপন্থি।

ওয়াটার পাম্পের বিশ্বখ্যাত ইটালিয়ান জায়ান্ট পেডরোলোর বাংলাদেশি এজেন্ট পেডরোলো এনকে লিমিটেড। পেডরোলো এনকে লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির মূল কর্ণধার নাদের খান। তিনি প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালকের দায়িত্বেও রয়েছেন।

সরকারি ৭৮৪ একরের বেশি জায়গা দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে হালদা ভ্যালি টি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মোবাইলে কথা বলা সম্ভব নয়। জানতে চাইলে অফিসে আসেন।’ আবার ফোন করা হলে জানান, জাপানি ডেলিগেট নিয়ে তিনি অফিসের বাইরে আছেন।

পরে হালদা ভ্যালির জায়গার বিষয়ে জানতে হলে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হালদা ভ্যালি চা বাগানের মালিক সরকারি জায়গা অবৈধভাবে দখল করেছেন। এক প্রভাবশালী মন্ত্রী চা বাগান কর্তৃপক্ষের পক্ষে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হালদা ভ্যালির সরকারি জায়গা অবৈধভাবে দখলের বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। ভূমি মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। তারপরেও আমরা জায়গাটি উদ্ধারে ফটিকছড়ির ইউএনওকে নির্দেশনা দিয়েছি। এরই মধ্যে ইউএনও জায়গাটি মার্কিং করেছেন। জায়গাটি অবৈধ দখলদার মুক্ত করা হচ্ছে।’

ভূজপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় আট মাসেও প্রতিবেদন না হওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে মামলাটি ইন-অ্যাক্টিভ রাখতে পারেন। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো।’

সর্বশেষ - আইন-আদালত