নির্বাচনের আগে খোদ বিএনপিসহ দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো এখন সক্রিয়। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে একাট্টা তারা। শোনা যাচ্ছে নির্বাচনের আগে বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা হতে পারে। যদিও এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে নারাজ। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ দলীয় পদে ফিরবেন কি না তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ছাত্রদলের এক সহ-সভাপতি জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শ্রাবণকে অসুস্থতার কথা বলে বিএনপি অব্যাহতি দিলেও তিনি ‘মহল বিশেষের’রোষানলে পড়ে দলীয় পদ হারান। এখন তাকে ছাত্রদল থেকে বিদায় জানাতে মরিয়া ওই পক্ষটি। শ্রাবণকে নিয়ে খোদ বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী প্রকাশ্যে তো দূরের কথা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গেও কথা বলতে পারছেন না। এমনকি শ্রাবণ স্বপদে ফিরে এলেও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলবে বলে মনে করছেন অনেকে।
এই ছাত্রনেতা বলেন, আওয়ামী পরিবারের কোনো ব্যক্তি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে যাচ্ছে এটা একটা পক্ষের জন্য অপমানজনক, তারা এটা মানতে পারছেন না। এ পক্ষই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছেন। তাদের কথা মানেই, ‘হাইকমান্ডের কথা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী যেটাকে বলছেন ‘বিকল্প হাইকমান্ড’। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘বিকল্প হাইকমান্ড’ নাকি স্বয়ং তারেক রহমানের চেয়েও ক্ষমতাশালী। এমনকি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও এই ‘বিকল্প হাইকমান্ড’ নামধারীদের ভয়ে মন্তব্য করেন না।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ‘বিকল্প হাইকমান্ড ‘তারেক রহমানকে বুঝিয়ে ছাত্রদলের কিছু ইউনিটের কমিটি দিয়েছে। যার প্রত্যেকটি কমিটিতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সবশেষ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে মারামারি হয়, যা নেতাকর্মীদের খুব বিব্রত করে। অনেকেই বলেছেন, দক্ষিণ জেলার কমিটি দ্রুত বাতিল না করলে আরও বড় অঘটন ঘটতে পারে। নেতাকর্মীদের আক্ষেপ হাইকমান্ড থেকে ‘বিকল্প হাইকমান্ড’যদি নিজেকে অধিক শক্তিশালী মনে করে, তাহলে সঠিক সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
বলা হচ্ছে, ‘বিকল্প হাইকমান্ড’ এর সর্বশেষ টার্গেটে পড়েন শ্রাবণ। শ্রাবণ যেন পদে ফিরতে না পারেন সেজন্য ওই পক্ষ এখন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের পাঁয়তারা করছে। কারণ শ্রাবণকে যদি বাদ দেওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে সামনের দিনে তাদের জন্য রাজনীতি আরও বেশি চ্যালেঞ্জের হবে। সেটা হবে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক তৃপ্তি। নেতাকর্মীদের ধারণা ‘বিকল্প হাইকমান্ডের’ ভয়ে এ পরিস্থিতিতে শ্রাবণের বিষয়ে বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বলবেন না। শ্রাবণেরও ফেরা হবে না।
দীর্ঘদিন পরেও শ্রাবণের সুস্থ হয়ে পদে ফেরা না ফেরা নিয়ে সংগঠনের মধ্যে আলোচনা চলছে। হঠাৎ করে নতুন কমিটি গঠনের আলেচনা ছড়িয়ে পড়ায় সংগঠনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংগঠনের দায়িত্বশীল একজন সহ-সভাপতি। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সভাপতি শ্রাবণের পক্ষের হয়ে রাজনীতি করিনি, তবে সভাপতি শ্রাবণের সঙ্গে সাংগঠনিক যেকোনো নির্দেশনা পালনে কাজ করেছি। দলের সংকটময় মুহূর্ত এখন, দলের মধ্যে যেমন ঐক্য মজবুত করা দরকার, তেমনি দলের নির্দেশনা বাস্তবায়নে রাজপথের আন্দেলনের প্রধান শক্তি হিসেবে ছাত্রদলের মধ্যে আরও ঐক্য মজবুত করা বাঞ্ছনীয়। সেক্ষেত্রে একজন দল ও সংগঠনপ্রেমী হিসেবে আমি প্রত্যাশা করবো, শ্রাবণকে দ্রুত স্বপদে বহাল করার। এখন আলোচনা সমালোচনা করার সময় নয়, এখন আমাদের মধ্যে ঐক্য এবং শক্তিশালী সংগঠক দরকার।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুগ্ম সম্পাদক বলেন, শ্রাবণ ফিরবেন নাকি নতুন কমিটি হবে সেটা আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়, আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় হলো সংগঠনকে শক্তিশালী করবেন নাকি দুর্বল করে নিজেদের পকেটে ভরে রাখবেন? তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত কমিটি দুই বছর মেয়াদ পার হওয়ার আগে ভাঙার আওয়াজ যারা দেন, তারা কী তারেক রহমানের নেতৃত্বকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত কি না ভেবে দেখা উচিত।
ছাত্রদলের বিভিন্ন সূত্র বলছে, শ্রাবণ সম্প্রতি আহত নেতাকর্মীদের দেখতে যাচ্ছেন, এর আগে তিনি রুহুল কবির রিজভীসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আদালতে মামলায় হাজিরা দিতেও গিয়েছিলেন। শ্রাবণ যদি অসুস্থ থাকতেন তিনি এগুলো করতে পারতেন না। আদালতে অসুস্থতার জন্য আবেদন করতেন। তা করেননি।
শ্রাবণের বিষয়ে জাগো নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, এটা তাকে (শ্রাবণকে) এবং ছাত্রদলকে জিজ্ঞেস করেন।
ছাত্রদল সহ-সভাপতি আক্তার হোসেন বলেন, শ্রাবণ সব সময় সুস্থ ছিলেন। দলীয় শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আপাতত তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান যেটা ভালো মনে করবেন সেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
শ্রাবণের বিষয়ে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নিজাম উদ্দিন রিপন বলেন, শ্রাবণকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা বা কথা হয়নি। আমি দুবার তার ফোনে কল করেছিলাম, রেসপন্স পাইনি।
নতুন কমিটি হওয়া নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে তবে সেরকম বাস্তবতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রাবণের সংগঠনে ফেরা না ফেরা বা নতুন কমিটি যেকোনো সিদ্ধান্ত বিষয়ে আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
শ্রাবণের বিষয়ে ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল বলেন, তিনি কী ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন সেটা সঠিক আমি জানি না। তবে আগের চেয়ে একটু ভালো। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
শ্রাবণ আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন, আহত নেতাকর্মীদের পাশে যাচ্ছেন শিগগির কী দায়িত্বে ফিরবেন এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল বলেন, ইমপ্রুভ করছেন। ফেরার বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আমার কথা হয়নি। দু-একদিনের মধ্যে কথা বলবো। নতুন কমিটি গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দায়িত্বশীল জায়গায় আমি এমন আলোচনা শুনিনি।
ছাত্রদলের সাবেক একজন সভাপতি বলেন, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক এবং সহ-ছাত্রবিষয়ক পদ দুটিতে সাধারণত ছাত্রদলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ব্যক্তিদেরই পদায়নের রীতি। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিনি বলেন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আজিজুল বারী হেলাল, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলিম, হাবিবুর রশিদ হাবিব, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল, তাদের মধ্যে থেকে কেউ দায়িত্ব পেলে ভালো করবে।
অন্যদিকে, সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদে ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টুদের থেকে কেউ দায়িত্ব পেলে ছাত্রদল সত্যিকার অর্থে হাইকমান্ডের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।
এদিকে, শ্রাবণের পদে ফেরা প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান খোকন বলেন, এ বিষয়ে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাবো।
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বলেন, শ্রাবণ দলের পুরোনো কর্মী। দলের প্রতি তার ডেডিকেশন রয়েছে। সে যদি সুস্থ বোধ করে দলীয় হাইকমান্ডকে জানাবে। হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত দেবেন। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। হাইকমান্ড যদি আমার কাছে মতামত নেয় সেটা ভিন্ন বিষয়।
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে বিএনপি সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন তাতে অসুস্থতার কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির সাবেক ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক বর্তমানে বিএনপির প্রচার সম্পাদক এবং মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, শ্রাবণ অসুস্থ, সুস্থ হলেই দায়িত্বে ফিরবেন। দলের শৃঙ্খলার রক্ষার্থে শ্রাবণকে বাদ দেওয়া হয়েছে এমন বক্তব্য মানতে নারাজ এ্যানি। তার ভাষ্য, শ্রাবণ দলে খুব সক্রিয় ছিলেন।
ছাত্রদলের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে বিষয়গুলো আলোচনা করা দরকার, দল সেই বিষয়গুলো নিয়েই ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে। ছাত্রদলের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগঠনটির সাবেক এই সভাপতি বলেন, তরুণ সমাজের আন্দোলন চলছে। কঠিন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পতন হবে, ছাত্রদল সেভাবেই সংগঠিত হচ্ছে।
তবে নতুন কমিটির বিষয়ে বার বার ফোন করেও বিএনপির ছাত্র-বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল এবং শ্রাবণের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত ৮ আগস্ট ছাত্রদলের সভাপতির পদ থেকে শ্রাবণকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর সংগঠনটির একাংশের অভিযোগ, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। তারই ‘কূটচালে’ শ্রাবণ সভাপতির পদ খুইয়েছেন। যদিও বকুল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাকচ করে বলেন, এটা গোয়েন্দা সংস্থার অপপ্রচার। যখনই সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে তখনই তারা এ ধরনের প্রচার চালিয়ে বিভ্রান্ত করতে চায়।