ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ফোকলোর বিভাগে আসন সংখ্যা ৮০টি। বিভিন্ন কোটাসহ এ বিভাগে ৮৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষেও বিভাগটিতে ৮৫ জন শিক্ষার্থীই ভর্তি হন। পরের শিক্ষাবর্ষে (২০২০-২১) চালু হয় গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি (জিএসটি)। এ ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী সংকটে পড়ে ফোকলোর বিভাগ। শূন্য পড়ে থাকে ৫২টি আসন। অর্থাৎ, আসনের বিপরীতে অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী পায় বিভাগটি। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষেও শূন্য থাকে ৩১টি আসন। চলতি (২০২২-২৩) শিক্ষাবর্ষেও বিভাগটিতে এখনো ২৬টি আসন ফাঁকা।
শুধু ফোকলোর বিভাগ নয়, বিভিন্ন বিভাগে ২১৭টি আসন ফাঁকা রেখে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি, যা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আসনের প্রায় ১০ শতাংশ। ৪৩ বছর বয়সী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রয়েছে মোট দুই হাজার ৯৫ জন শিক্ষার্থীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার (একাডেমিক) মো. শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসন সংকট তো কাটছেই না। ভর্তি হয়েও অনেকে বাতিল করে চলে যাচ্ছে। সেই আসন ফাঁকা হচ্ছে। এখন তো মাইগ্রেশন-ভর্তি সব বন্ধ। ২১৭টির মতো আসন শূন্য। ফোকলোরে ২১টি, মার্কেটিংয়ের মতো বিভাগে ১৩টি ফাঁকা। আরও অনেক বিভাগে কম-বেশি ফাঁকা। ভর্তি বাতিল হলে আরও বাড়বে। কীভাবে এগুলো পূরণ হবে বা আদৌও পূরণ হবে কি না, তার কিছুই জানি না।’
বিভাগটির সভাপতি ড. আবু শিবলী মো. ফাতেহ আলী চৌধুরী বলেন, ‘গুচ্ছে ত্রুটি বা বাস্তবায়নে সংকট আছে কি না, তা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারবো না। তবে শিক্ষার্থী সংকট হচ্ছে। এটা বড়ই দুঃখের, কষ্টের। আমি চাইবো এ আসনগুলো পূরণে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকাদের গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হোক। সেটা মেধার ভিত্তিতেই করা হোক।’
আসন শূন্য রেখে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করার এ চিত্র শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়। গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটিতেই কম-বেশি আসন শূন্য। হিসাব কষলে শূন্য আসনের সংখ্যা প্রায় ২২শ। অথচ গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে গত ২২ আগস্ট। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিতো, তখন এত সংখ্যক আসন কখনো শূন্য থাকেনি বলছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
২২০০ আসন শূন্য, তবুও ভর্তিচ্ছুদের স্বপ্নভঙ্গ
গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১১টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। ৯টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে একটি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০ হাজারের কিছু বেশি আসন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৭৬৫টি আসন রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুচ্ছভুক্ত সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (শাবিপ্রবি) ১৬২টি আসন শূন্য। মাত্র এক হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়ালেখা ও গবেষণায়ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ সুনাম। অথচ সেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও ১২টি আসন শূন্য। ভর্তি বাতিল হলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি কমিটির সদস্যদের। রাজধানীর ঢাকার অন্যতম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। গুচ্ছভুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ও দেড় শতাধিক আসন ফাঁকা রেখে ভর্তি শেষ করতে বাধ্য হয়েছে।
পদ্ধতির গ্যাঁড়াকলে আরও বেশি বিপাকে নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট বেশি। অল্প আসন থাকা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার খুবই কম। ফলে এখনো প্রায় শিক্ষার্থীশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সবমিলিয়ে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজার ২শ আসন ফাঁকা। অথচ কয়েক লাখ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নে ছুটে বেড়াচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত আসন পূরণে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া গেলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্নভঙ্গ হবে তাদের।
গুচ্ছ ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক ও শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসন আমরা শূন্য রাখতে চাই না। সেগুলো পূরণ করবো। টেকনিক্যাল যে কমিটি রয়েছে, তারা প্রস্তাবনা দেবে। সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। তবে মাইগ্রেশনটা স্টপ (বন্ধ) রাখবো।’
ভোগান্তি বাড়ছে, মাইগ্রেশন ফাঁদে চরম বিশৃঙ্খলা
গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতিতে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইগ্রেশন (স্থানান্তর)। চার দফা মাইগ্রেশনে শিক্ষার্থীকে ছুটতে হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে শিক্ষার্থী অভিভাবকের ভোগান্তির সঙ্গে বাড়ছে খরচও। চরমে উঠেছে একাডেমিক বিশৃঙ্খলাও।
ভর্তির প্রথম ধাপে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান জোবায়ের হোসেন। তার বাড়ি নাটোরে। প্রথম মাইগ্রেশনে তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। দ্বিতীয় দফা মাইগ্রেশনে ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবশেষ তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
জোবায়ের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গুচ্ছ পদ্ধতিতে আপনি মাইগ্রেশন চালু রাখলে চয়েজে (পছন্দক্রম) অটো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন। আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। কিন্তু প্রথম ধাপে আমার মেধাক্রম অনুযায়ী পেয়েছিলাম বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বাধ্য হয়ে সেখানে ভর্তি হতে হয়েছিল। ভর্তি না হলে আমার মেধাক্রম বাতিল হয়ে যেত। আমি ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও আর ভর্তি হতে পারবো না।’
‘আবার মাইগ্রেশন একবার বন্ধ করলে আর মাইগ্রেশন চালু করা যাবে না। যেখানে ভর্তি হয়েছি, সেখানেই থাকতে হবে। অথচ দেখা যাবে, খুলনা বা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়েও পরে আসন ফাঁকা হচ্ছে। কিন্তু আমার যাওয়ার সুযোগ থাকছে না।’ বলছিলেন ভর্তিচ্ছু জোবায়ের হোসেন।
তার মতোই তিন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে অবশেষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ভর্তি হয়েছেন আকলিমা খাতুন। বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। মেয়ের ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। আকলিমার নেই কোনো ভাই-বোনও। একাই কুমিল্লা, ঢাকা ঘুরে রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে।
ভোগান্তি-হয়রানিতে ক্ষুব্ধ আকলিমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ক্লাসও করেছি। সেখানে থাকার জায়গা নেই। এক বড় আপুর মেসে থেকে কয়েকদিন ক্লাস করতে হয়েছে। মাইগ্রেশন হবে কি না, তখনও জানতাম না। খুব ভোগান্তি-হয়রানিতে পড়েছি আমি। আমাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।’
বেড়েছে খরচের বোঝাও
গুচ্ছ ভর্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের খরচ কমানো। একবার টাকা দিয়ে আবেদন করলেই যাতে আর খরচ না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে পরীক্ষা দেওয়ার খরচও যাতে কমে। কিন্তু ঘটছে উল্টো। ১৫শ টাকা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন করছেন শিক্ষার্থীরা।
ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় নাম এলে ভর্তি আবেদন ও বিভাগ পছন্দক্রম দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়প্রতি ফি ৫শ টাকা। কেউ যদি সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দক্রমে দেন, তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি গুনতে হবে। এ-তো গেলো আবেদন ফির খরচ। প্রথম ধাপে কেউ যদি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পান, তাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ভর্তি হতে হবে।
মাইগ্রেশনে ওই শিক্ষার্থী যদি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পান, সেখানেও তাকে আলাদাভাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি হতে হবে। পরে যতবার মাইগ্রেশনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন হবে, ততবারই নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে। এতে খরচ কমেনি, বরং আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শিক্ষার্থী আকলিমা খাতুনের ভাষ্য, ‘বারবার ভর্তির জন্য টাকা নেওয়ার ব্যবসা খোলা হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত ভর্তির জন্য আমি অগ্রিম (প্রাথমিক নিশ্চায়ন বাবদ) পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলাম। যখন কাগজপত্র নিয়ে সশরীরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলাম, আগে দেওয়া টাকার সঙ্গে আরও আট হজার ৬০ টাকা লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন মাইগ্রেশনে আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলাম। এখানেও আমাকে আবার পাঁচ হাজার ৪শ টাকা দিতে হয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত ফি (কেন্দ্রীয় ফির বাইরে)। সবশেষ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাকে আবার চার হাজার ৮৭০ টাকা দিতে হলো। আর অনলাইনে ভর্তির কাজ করাতে কম্পিউটার দোকানের খরচ, যাতায়াত খরচও হয়েছে বহু। ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে অনেক।’
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের খরচ যে কমেছে, তা নয়। একজন শিক্ষার্থী তো ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেত না। বেছে বেছে হয়তো সে পাঁচ-সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতো। সেই হিসাব ধরলে এ পদ্ধতিতে খরচটা ওদের বেশিই হচ্ছে। এটা ভর্তির যে টেকনিক্যাল কমিটি, তারা চাইলে এড়াতেও পারেন। এ নিয়ে আমি কথা বলেছি বৈঠকে। কারও সাড়া তো মেলেনি।’
‘আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপ নিচ্ছে উচ্চ শিক্ষাঙ্গন
মাগুরা সদর উপজেলায় বাড়ি শাকিল আহমেদের। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় নাম আসে তার। ভর্তির প্রাথমিক আবেদনে প্রথম পছন্দ দেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ। তবে তিনি পান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। পরে মাইগ্রেশন করেন।
শাকিল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আমার বাড়ির কাছে। বাসা থেকে বেরিয়ে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঝিনাইদহ বাস টার্মিনালে গেলে ওখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি পাবো। প্রতিদিন বাড়ি থেকেই তো ক্লাস করতে পারবো। এজন্য এখানে ভর্তি হয়েছি। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পেলেও ছেড়ে এসেছি।’
একইভাবে গাইবান্ধার আকলিমা রংপুরে থেকে যেতে চেয়েছেন। তিন বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে পছন্দের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। কারণ সেটা তার পাশের জেলায় অবস্থিত।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তুলনামূলক ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ও ভালো বিভাগ ছেড়ে তারা এলাকার শিক্ষা-গবেষণায় পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের এমন মনোভাব ‘বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার’ সঙ্গে বড্ড বেমানান বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। তাদের এ ধরনের প্রবণতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে ‘আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়’।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ক্লাসে আমি ৬৪ জেলার না হলেও অনেকগুলো জেলার শিক্ষার্থী পেতাম। তাদের সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা-ধারণা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করতাম। কিন্তু গত দুই-তিন বছর দেখছি ক্লাসে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইলের সবাই। বড়জোর খুলনা-যশোরের আরও কিছু শিক্ষার্থী। আমি অবাকই হয়েছি বটে।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কেন এমন আঞ্চলিকতায় রূপ নিচ্ছে, সেটা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। এটা কী বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ, ধারণা, চিন্তার সঙ্গে যায়? উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ যদি স্থানীয় কলেজ-স্কুলের মতো হয়ে পড়ে, তাহলে চিন্তার জগৎ ছোট হয়ে আসতে বাধ্য। এটা নিয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সবার ভাবা উচিত।’
সংকট কাটাতে গুচ্ছ এড়িয়ে এনটিএতে ঝোঁক
গুচ্ছ পদ্ধতি ‘ভালো’ হলেও বাস্তবায়নে নানা সংকটের কথা স্বীকার করছেন ভর্তি কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তারা বলছেন, গুচ্ছ নিয়ে নানা সংকট রয়েছে, এটা কাটিয়ে ওঠার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। ন্যাশনাল টেস্ট অথোরিটি (এনটিএ) করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। এনটিএ চালু করতে একটি নীতিমালা করার পরিকল্পনা করা হয়। তাতে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আজম শান্তনু জাগো নিউজকে বলেন, ‘জিএসটি সিস্টেমটা যে খারাপ তা নয়, এটা বাস্তবায়নে অনেক সময় এদিক-সেদিক হতে পারে। নতুন যে কোনো সিস্টেমে এমন সমস্যা দেখা যায়। এখন আসন শূন্য রয়েছে অনেক। এটার সমাধানে ভর্তি কমিটি চেষ্টা করছে। একাধিক বৈঠক হয়েছে, আরও হবে। সেখানে আমি বলেছি- মাইগ্রেশনটা বন্ধ রেখে মেধাতালিকার ভিত্তিকে যারা অপেক্ষমাণ, তাদের ভর্তি করানো হোক। এটাতে অনেকের সায়ও রয়েছে। কোনো শিক্ষক বা ভর্তি কমিটির সদস্যই চান না যে, আসন শূন্য থাকুক। সবাই আসন পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে। তবে কীভাবে হবে, সেটা এখন আলোচনার বিষয়।’
গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষকদের অনেক আপত্তি। চলতি শিক্ষাবর্ষে এ পদ্ধতি বাতিলে শিক্ষক নেতাদের তোড়জোড়ও ছিল। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের নির্দেশনায় এবারও এটা বহাল থেকে গেছে। আগামী বছর কি গুচ্ছ তাহলে বাতিল হচ্ছে— এমন প্রশ্নে গুচ্ছ ভর্তি কমিটির অন্যতম এ সদস্য বলেন, ‘দেখুন, এ পদ্ধতিটা করা হয়েছিল ভোগান্তি কমাতে, আর্থিক চাপ কমাতে। রাষ্ট্রপতির নির্দেশনাও ছিল, এটা সত্য। আমরা কেউই এটা বাতিল হোক বা শেষ করে দিতে চাই—এমনটা নয়। এটার বিকল্প কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। অথবা এ পদ্ধতিকে আরও ত্রুটিমুক্ত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। আমরা এনটিএ উদ্যোগের কথা শুনেছিলাম। সেটা নিয়ে কাজ চলছে। হয়তো আরও এক বা দুবার গুচ্ছ পদ্ধতিতে আমাদের চালিয়ে নিতে হবে। নতুন কোনো মডেল বা সিস্টেম দাঁড় করানো গেলে, সেটাতে শিফট হওয়া যাবে।’
গুচ্ছ পদ্ধতির সংকট ও এনটিএ চালু প্রসঙ্গে ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুন প্রক্রিয়া এলেই কিছুটা সংকট হতে পারে। শিক্ষার্থীরা তো এখন সব অনলাইনেই করতে পারছে। এটাতে যদি বড় আপত্তি আসে, তাহলে এনটিএ হোক বা অন্য কিছু হোক, সেটা করার ক্ষেত্রে আপত্তি দেখি না। আমি মনে করি, নেক্সটে যে মডেলই আসুক, তা যেন আগে দীর্ঘ সময় পাইলটিং প্রক্রিয়ার মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর বাস্তবায়নের পথে হাঁটা মঙ্গলজনক হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্তি দায়িত্বে) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউজিসির লক্ষ্য হলো- ভর্তি প্রক্রিয়া সহজতর করা। গুচ্ছ পদ্ধতি অনেকটা সেই পথে এগিয়ে দিয়েছে বলে মনে করি। এখানেও কিছু সংকট আছে, থাকবে। এটাকে মোডিফাই করা যেতে পারে। এখান থেকে আগের সিস্টেমে ফেরার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ন্যাশনাল টেস্ট অথরিটি গঠনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি কাজ করে, সেখানে ইউজিসির যেটুকু ভূমিকা তা আমরা রাখবো।’