আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা মাগুরাকে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফরিদপুর জেলার মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে ২৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন। কিন্তু সংস্থান অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি নেই।
জানা গেছে, প্রায় ১১ কিলোমিটার রেললাইন তৈরিতে ১১২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রকল্পের প্রায় পাঁচটি অর্থবছর অতিবাহিত হলেও ভূমি অধিগ্রহণের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও ছাড় জরুরি হয়ে পড়েছে।
মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, জমি অধিগ্রহণের কালক্ষেপণ প্রকল্পের কাজ দেরি হওয়ার একটি প্রধান কারণ। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক মাগুরাকে খসড়া প্রাক্কলনের ভিত্তিতে ১৫৫ কোটি টাকা এবং জেলা প্রশাসক ফরিদপুরকে চূড়ান্ত প্রাক্কলনের ভিত্তিতে ৪০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ফরিদপুরকে অতিরিক্ত আরও ৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ভূমি অধিগ্রহণের জন্য আর কোনো অবশিষ্ট না থাকায় তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। আলোচ্য প্রকল্পটি নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এ নিবিড় পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা, কাজের মান, অগ্রগতি, আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখা। প্রকল্পটি উপকারভোগীদের জন্য কতটুকু সুযোগ নিয়ে আসবে তা যাচাই করা। প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, কাজের গুণগতমান পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ, প্রশ্নোত্তর জরিপ ও কর্মশালার মাধ্যমে নিবিড় পরিবীক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী (পশ্চিম) এবং এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আসাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে সমস্যা হচ্ছে, যে কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি কম। ভূমি অধিগ্রহণে বিভিন্ন তারিখ ও নোটিশ পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পেমেন্ট করতেও দেরি হয়েছে।
নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে দাবি করে প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, কিছু জটিলতা রয়েছে, প্রকল্পের প্রাইস এড্রেস হয়নি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে এখনও সমাধান হয়নি প্রকল্পের মেয়াদ ফের বাড়বে কি না। তার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রকল্পের কাজে আগের চেয়ে গতি বেড়েছে কিছুটা। জিনিসপত্রের দামও কমছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আইএমইডি জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়া চন্দনা নদীতে ব্রিজ স্থাপনে সমস্যা হচ্ছে, যা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন।
এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেকারণে বাংলাদেশ রেলওয়েকে কিছু সুপারিশও দিয়েছে আইএমইডি। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পটি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নকশা অনুসারে নির্মাণকাজের জন্য ফ্রি একসেস দেওয়া প্রয়োজন। সময় মতো বৈদেশিক মেটেরিয়াল যেমন-রেলট্র্যাক, ব্রিজ গার্ডার, এইচ-বিম, সিগন্যালিং ও কমিউনিকেশন সরঞ্জাম, রেললাইন ইলেক্ট্রিফিকেশন ও ডিজেল পাওয়ার সিস্টেম, সংগ্রহ করা প্রয়োজন। যথাসময়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভার আয়োজন ও সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা প্রয়োজন। দ্রব্যের মূল্যমান প্রয়োজন হওয়ায় তার সমন্বয় করা জরুরি। প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কাজের তৎপরতা, তদারকি ও শক্তি বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
আইএমইডি আরও জানায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রকল্প চলাকালীন নিবিড় পরিবীক্ষণ একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি বর্তমান মেয়াদের মধ্যে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এজন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণে বাড়তি ব্যয় মেটাতে ডিপিপির বিশেষ সংশোধের প্রয়োজন পড়ে। এরই মধ্যে ডিপিপিটির বিশেষ সংশোধনের জন্য রেলভবনে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এটি অনুমোদিত হলে অবশিষ্ট টাকা জেলা প্রশাসক ফরিদপুরকে দেওয়া সম্ভব হবে। ভূমি অধিগ্রহণে প্রাক্কলিত ব্যয়ের হিসাব ঠিক মতো করা হয়নি। ডিপিপির গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আইএমইডি আরও বলছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, অন্যান্য প্রকল্পের মতো করোনার কারণে এ প্রকল্প কার্যক্রমেও বাধা তৈরি হয়। এতে সরকার ও ব্যবসায়িক সংস্থার মালামাল এবং উপকরণের সরবরাহে অনিশ্চয়তা ও সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে পরিবহনের সমস্যা ও আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল। আবার এ পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশ ও বিধিমালা পরিবর্তিত হয়েছে। কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের কর্মস্থল এবং প্রকল্প সাইট থেকে বহুদিন দূরে থাকতে হয়েছে, যা প্রকল্পের অগ্রগতি ও কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। সরকার বিভিন্ন বিধিমালা প্রণয়ন করেছে; ফলে ব্যবসায়ী সংস্থা ও পরিবহন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে বিশেষ নিয়মাবলি অনুসরণ করতে হয়েছে। এতে পরিবহনের ব্যবহার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সময়সূচি বাধ্যতামূলক করা হয়।
আইএমইডি আরও জানায়, প্রকল্প পরিচালকের মতে, করোনা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে লগ-ফ্রেম অনুযায়ী প্রকল্পের আউটপুট সময়ানুপাতিক হারে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রব্যের মূল্যমান সমন্বয়ের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সহায়তা ও সহযোগিতা চাচ্ছেন। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কাজের অগ্রগতি খুবই কম। মূল ডিপিপিতে চন্দনা ব্রিজের স্প্যান ছিল তিনটি, যার পরিমাপ ছিল ৯০ মিটার, যা নির্মাণ-সংক্রান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই করে তৈরি করা। কিন্তু বাস্তবে সেই নকশা অনুসারে ব্রিজ নির্মাণ করতে গেলে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পরিবর্তন করে ১২০ মিটারের চারটি স্প্যান করার প্রয়োজন পড়ে। এখন অসুবিধা হলো ব্রিজটির কাজ সম্পন্ন করতে ব্যয় ও সময় উভয়ই বাড়বে। সম্ভাব্যতা যাচাই করার সময় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে করা দরকার ছিল বলে মনে করেন তারা।
প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১ হাজার ২০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় এবং বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের ১ মে থেকে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নির্ধারিত হয়।
প্রকল্প অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের মোট আর্থিক অগ্রগতি ৪৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা বা ৩৬ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৪০ শতাংশ। সময় অতিক্রান্ত বিবেচনায় প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতির তুলনায় আর্থিক অগ্রগতি পিছিয়ে আছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি দ্রুত বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে রেলপথ চালু হয়। এরপর ১৮৭০ সালে গড়াই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ১৮৭১ সালে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। দক্ষিণাঞ্চল থেকে বাঁশ, বেত ও পাট পরিবহনের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৩২ সালে কালুখালী থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত রেলপথ স্থাপিত হয় এবং একই সময়ে মধুখালী থেকে কামারখালী ঘাট পর্যন্ত আরেকটি শাখা লাইন নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ শাখা লাইনটি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমান সরকার রেললাইন প্রকল্প ঢেলে সাজিয়েছে। প্রতিটি জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এ পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।