বছর ঘুরে আবার এলো সিয়াম সাধনার মাস রমজান। পুরো মাস আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিশ্ব মুস্লিম উম্মাহ রোজা পালন করবেন। রোজা পালন এবং ইবাদতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সারাবিশ্বের মুসলিমরা একইভাবে সেহরির মাধ্যমে রোজা শুরু করেন এবং ইফতারের মাধ্যমে শেষ করেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সময় নানান ধরনের বিচিত্র রীতি পালন করা হয়। যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু মুসলিম দেশের রোজা পালনের রীতি সম্পর্কে-
মিশর
রোজার সময় মিশরীয়রা খুব সুন্দর করে কাঠের ফ্রেমের লণ্ঠন এবং বিভিন্ন বাতি দিয়ে তাদের বাড়ি এবং রাস্তা সাজায়। পুরো মাস এভাবে আলোকিত থাকে মিশরের রাস্তাগুলো। তাদের কাছে এই লণ্ঠন বা বাতি একতা এবং আনন্দের প্রতীক। মিশরীয় লণ্ঠনের উৎপত্তির গল্প ভিন্ন। কথিত আছে, ৩৫৮ হিজরিতে (৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ) রমজানের পঞ্চম দিনে, ফাতেমীয় খলিফা মোয়ায়েজ এল-দিন এল-আল্লাহ কায়রোতে প্রবেশ করছিলেন। যে শহরটি তার সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিল। সন্ধ্যার পর যখন তিনি আসছিলেন, তখন বাসিন্দারা কাঠের ফ্রেমের মধ্যে মোমবাতি নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিল তাকে স্বাগত জানাতে এবং তার আগমন উদযাপন করতে। পরবর্তীকালে এই কাঠের কাঠামোগুলো প্যাটার্নযুক্ত লণ্ঠনে পরিণত হয়।
তুরস্ক
রমজানের সময় সেহরির আগে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে কিংবা রাস্তায় গান গেয়ে বা মানুষজনকে ডেকে জাগিয়ে তালো বাংলাদেশে বেশ পরিচিত একটি দৃশ্য। তবে এখন এই ব্যাপারটি খুব কম দেখা গেলেও তুরস্কে এই রীতি বহুকাল আগের। সেদেশে প্রায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ আছেন যারা রমজানজুড়ে ড্রাম বাজিয়ে সেহরিতে মুসলিমদের ডেকে তোলেন।
অটোম্যানদের মতো তুর্কিরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ‘দাভুল’ নামের বড় আকারের ঢোল পিটিয়ে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলে। দুই দিকেই বাজানো যায় এমন ঢোল নিয়ে শহরজুড়ে ঘুরে ঘুরে সেহরির জন্য মানুষদের জাগিয়ে তোলা হয়। এর বিনিময়ে বখশিস পায় তারা। এসময় সেহরিতে জেগে ওঠা মুসলিমরা একসঙ্গে খাওয়ার জন্য তাদের ডাকও দেয়।
অনেকটা একই চর্চা আছে আলবেনিয়ার রোমা মুসলিমদের মধ্যে। ভেড়া বা ছাগলের চামড়ায় আবৃত লোদ্রা নামের ঐতিহ্যবাহী ড্রামের সঙ্গে বিশেষ গীতিনাট্য দিয়ে তারা রমজানে দিনের শুরু এবং শেষ করে। সম্প্রতি তুর্কি কর্মকর্তারা ড্রামদের জন্য একটি সদস্যতা কার্ড চালু করেছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
রমজান শুরু হবার আগেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে চালু হয় ‘হক আল লায়লা’ নামের এক বিশেষ আয়োজন। রমজানের ঠিক আগের মাস অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখে। এই দিন শিশুরা রঙিন কাপড় পরে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যায়। এসময় তারা খারিতা ব্যাগে মিষ্টি সংগ্রহ করে এবং সুর করে বলে ‘আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইউদিকুম’, যার অর্থ ‘আপনারা আমাদেরকে দিন, আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কা পরিদর্শনের তৌফিক দেবেন।’
বছরর পর বছর ধরে ধর্মীয়ভাবে চর্চা করা ‘হক আল লায়লা’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজান পালনের ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হল রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কুয়েতেও এটি পালন করা হয়। তবে তা হয় রমজানের মাঝামাঝি সময়ে তিন দিনের উদযাপন। এসময় শিশুরা তাদের আশেপাশের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে থাকে এবং মিষ্টি এবং চকলেটের জন্য গান গায়। এই ঐতিহ্যটিকে ‘গারগিয়ান’ বলা হয়।
মিশরীয়রা হালকা রঙিন লণ্ঠন:
রমজানের সময়, মিশরীয়রা ফানুস “লণ্ঠন” দিয়ে রাস্তা সাজায়, পবিত্র মাসে আলো ছড়ায়। এই লণ্ঠন একতা এবং আনন্দের প্রতীক। মিশরীয় ফানুসের উৎপত্তির গল্প ভিন্ন। একজন বলেছে যে 358 হিজরিতে (969 খ্রিস্টাব্দ) রমজানের পঞ্চম দিনে, ফাতেমীয় খলিফা মোয়ায়েজ এল-দিন এল-আল্লাহ কায়রোতে প্রবেশ করছিলেন – যে শহরটি তার সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিল – প্রথমবারের মতো। সন্ধ্যার পরে যখন তিনি আসছিলেন, তখন বাসিন্দারা মোমবাতি নিয়ে কাঠের ফ্রেমে আশ্রয় দিয়েছিল যাতে তারা উড়িয়ে না দেয়, তাকে স্বাগত জানাতে এবং তার আগমন উদযাপন করতে। পরবর্তীকালে, এই কাঠের কাঠামোগুলি প্যাটার্নযুক্ত লণ্ঠনে পরিণত হয়।
ড্রামাররা তুরস্কে সুহুর ঘোষণা করে:
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো, 20,000-এরও বেশি ড্রামার তুরস্কের চাপে ঘুরে বেড়ায় মুসলমানদেরকে সেহরির জন্য জাগিয়ে তুলতে। রমজান “দাভুলকুসু” একটি ফেজ এবং ভেস্ট সহ একটি ঐতিহ্যবাহী অটোমান পোশাক পরিধান করে। “সম্প্রতি, তুর্কি কর্মকর্তারা ড্রামদের জন্য একটি সদস্যতা কার্ড চালু করেছেন যারা বাজায় তাদের মধ্যে গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল দেশে এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে একটি তরুণ প্রজন্মকে উত্সাহিত করে।”
সংযুক্ত আরব আমিরাতে শিশুরা মিষ্টির জন্য গান গায়:
অথবা যাকে আমরা ট্রিক-অর-ট্রিটিং-এর মুসলিম সংস্করণ বলি। “হক আল লায়লা” প্রথাটি 13, 14 এবং 15 রমজানে অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যটি বাহরাইনে শুরু হয়েছিল, যেখানে শিশুরা একটি ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় গান গাওয়ার সময় মিষ্টি সংগ্রহ করে উজ্জ্বল পোশাক পরে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইয়ুদিকুম , যা আরবি থেকে অনুবাদ করে ‘আমাদের দান করুন এবং আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কায় আল্লাহর ঘর পরিদর্শনে সহায়তা করবেন।’ এখন, এই ঐতিহ্যটি উপসাগরীয় দেশগুলিতে পালিত হয়, শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন এবং পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরে।
মরক্কোর
এ দেশেও গান গেয়ে একদল মানুষ মানুষের ঘুম ভাঙান সেহরিতে। তাদের মরক্কোতে ডাকা হয় নাফারস নামে। এসময় তারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গান্দোরা’, টুপি এবং একজোড়া চপ্পল পরে প্রার্থনার সুরে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। রমজানের শেষ রাতে মরক্কোর এই দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য এই ব্যক্তিদের সম্মানী দেওয়া হয়।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মুসলমানদের জন্য রমজানের আগে নিজেদের শুদ্ধ করার একটি পদ্ধতি ‘পাদুসান’। এর অর্থ গোসল করা। রমজান শুরুর আগে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা তাদের আশেপাশের প্রাকৃতিক পুকুরে গোসল করে এবং নিজেদের পরিষ্কার করে। এই সাংস্কৃতিক চর্চা রমজান মাসে বিশ্বাসীদের শুদ্ধ করে বলে মনে করেন মুসলিমরা। তবে ইদানীং অনেকেই নিজ বাড়িতেই এই গোসল করে নেন।
সিরিয়া
ইফতারের জন্য তারা কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ‘মিদফা আল ইফতার’ নামে পরিচিত এই প্রথাটি মিশরে শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। ২০০ বছর আগে দেশটি অটোমান শাসক খোশ কদম দ্বারা শাসিত হয়েছিল। সূর্যাস্তের সময় একটি নতুন কামান পরীক্ষা করার সময় ভুলবশত এটি গোলা বের হয়ে যায়। কায়রো জুড়ে সেই আওয়াজ ধ্বনিত হয়। সব মানুষ শুনতে পান সেই গোলার আওয়াজ। রমজান মাস হওয়ায় অনেকে ভাবতে থাকেন এটি হয়তো উপবাসের সমাপ্তির সংকেত দেওয়ার নতুন উপায়। তবে এই ভুলকেই সবাই খুব প্রশংসা করে এবং শেষমেশ কামানের তোপধ্বনি ঐতিহ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে সিরিয়া ও লেবাননের মতো অন্যান্য দেশও এই ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে।
সূত্র: কারাম ফাউন্ডেশন, কালচার ট্রিপ