পুতিনের আগ্রাসনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং শেনজেন জোনের ভিসা পাওয়া রাশিয়ানদের জন্য ইতিমধ্যে কঠিন হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রেমলিন কয়েক দফায় ইইউ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে এবং রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার কড়া ধরন ইইউ-রাশিয়ান অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করেছে; এমনকি স্বতন্ত্র অ্যাকাউন্টধারীদের জন্যও এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। সাধারণ হিসেবে এই সমস্যার দায় স্পষ্টতই ক্রেমলিনের ঘাড়ে বর্তায়। কারণ, যখন ক্রেমলিন নিজেই তার নাগরিকদের ভোগান্তিতে ফেলছে এবং তাদের স্বাধীনতার সীমারেখা সীমিত করে ফেলছে, তখন রাশিয়ান নাগরিকদের ভিসা নিশ্চিত করার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৈতিক দায় নেই।
ব্রাসেলস এবং ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলো অনেক দেশের নাগরিকদের জন্য, প্রধানত ‘গ্লোবাল সাউথ’ এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়া খুব কঠিন করে তুলেছে। কোনো সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই রাশিয়া এ তালিকায় যুক্ত হবে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার ওপর বিধিনিষেধের আহ্বানের বিষয়টি ইউরোপীয় বিতর্কে নতুন উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিশেষত পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলো রাশিয়ান আগ্রাসনের ঝুঁকিতে রয়েছে, তারা এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পক্ষে রয়েছে। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন রাশিয়ার নাগরিকদের জন্য পর্যটন ভিসা সুস্পষ্টভাবে সীমাবদ্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
অবশেষে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা পুতিনের প্রচার-অপপ্রচারকে আরও জোরালো করবে। পুতিন স্পষ্ট করেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ উদারতাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতার মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। নতুন ধরনের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে এ আদর্শগুলোকে বলি দিলে তা পুতিনের আগ্রাসনকে পরাস্ত করবে না, বরং ইউরোপকে দুর্বল করে দেবে।
১১ আগস্ট এস্তোনিয়ার সরকার প্রথম একক ইউরোপীয় দেশ হিসেবে নিজস্ব নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর আওতায় যেসব রুশ নাগরিকের এস্তোনিয়ার ইস্যু করা শেনজেন ভিসা রয়েছে, তাঁদের এস্তোনিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এখনো দেশটি তাদের ইস্যু করা শেনজেন ভিসায় অন্য দেশগুলোতে রুশ নাগরিকদের যাওয়া থেকে বিরত করেনি। ফিনল্যান্ড ১৭ আগস্ট ঘোষণা করেছে, তারা রাশিয়ানদের ভিসা দেওয়া ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেবে। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও ডেনমার্কও বিভিন্ন মাত্রার নিষেধাজ্ঞার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বুচা, মারিউপোল এবং অন্যান্য অগণিত বিধ্বস্ত ইউক্রেনীয় নগর ও শহরের ভয়াবহতা স্বাভাবিকভাবে ইউরোপীয়দের মধ্যে একটি আবেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তুলেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলীয় সদস্যদেশগুলো যৌক্তিকভাবেই তাদের দোরগোড়ায় রাশিয়ার সম্ভাব্য উপস্থিতিকে হুমকি হিসেবে দেখছে। কয়েক দশকের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে প্রধানমন্ত্রী মারিনের নেতৃত্বে ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ার ভিসা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এগিয়ে নেওয়া একটি ভুল পদক্ষেপ। কারণ, যুদ্ধের ভয়াবহতা যদি আমাদের মূল্যবোধকে মুছে ফেলে, তাহলে সেটি পুতিনকেই নৈতিকভাবে জয়ী করবে।
প্রথমত, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা উদারতার পরিপন্থী হবে। পুতিন সরকারের ক্রিয়াকলাপের জন্য রাশিয়ান জনগণকে নাগাড়ে শাস্তি দেওয়ার প্রতিটি আহ্বানই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’র সমার্থক হবে। আইএসের নৃশংসতার জন্য আমরা ইরাক ও সিরিয়ার জনগণকে দায়ী করতে পারি না। যারা ক্ষুধা, যুদ্ধ বা স্বৈরাচারের কারণে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের আরও শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। একইভাবে আমরা পুতিনের আগ্রাসনের কারণে রুশ নাগরিকদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।
পুতিন রাশিয়া নন এবং রাশিয়াও পুতিন নয়
দ্বিতীয়ত, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেবে। রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া, পশ্চিমা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা এবং বৈশ্বিক ডলার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করা পুতিনের শাসনের দ্বারা সৃষ্ট হুমকিকে হ্রাস করার উপায়। এর মধ্যে রুশ নাগরিকদের ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এসব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব হালকা হতে পারে।
অবশেষে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা পুতিনের প্রচার-অপপ্রচারকে আরও জোরালো করবে। পুতিন স্পষ্ট করেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ উদারতাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতার মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। নতুন ধরনের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে এ আদর্শগুলোকে বলি দিলে তা পুতিনের আগ্রাসনকে পরাস্ত করবে না, বরং ইউরোপকে দুর্বল করে দেবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো