রাজধানী ঢাকার সড়কে সাইকেল লেন, এমন খবরে খুশিতে আত্মহারা ছিলেন সাইক্লিস্টরা। ব্যয়বহুল আর যানজটের নগরীতে একটু স্বস্তির বার্তা পেয়েছিল স্বাস্থ্যসচেতন এবং সাইকেল প্রিয় মানুষরা। কিন্তু সেই খুশির আমেজ এখন অনেকটাই ফিঁকে হয়ে গেছে।
উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসম্মত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবেশবান্ধব যান চলাচল ও ব্যয় সংকোচনে সড়কে থাকে সাইকেল লেন। এই দ্বিচক্র যান দিয়ে নিরাপদে খুব সহজেই চলাচল করতে পারে নগরবাসী। ঢাকায়ও সাড়া ফেলে পরীক্ষামূলক সাইকেল লেন। রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া এভিনিউতে আলাদা সাইকেল লেন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে ঘটা করে উদ্বোধন হলেও তার অস্তিত্ব এখন মেলা ভার।
ডিএনসিসির তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকায় সাইকেল চলাচল উৎসাহিত করতে আগারগাঁওয়ে প্রায় ৯ কিলোমিটার সড়কে আলাদা লেন তৈরি করা হয়। একই বছর ১৫ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে ৬ ফুট প্রশস্ত সাইকেল লেন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে ডিএনসিসি। আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তরপ্রান্ত থেকে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভবন পর্যন্ত সাইকেল চালানোর জন্য করা হয় আলাদা লেন। ২০২০ সালের মার্চে উদ্বোধনও করা হয় লেনটি। সে সময় ডিএনসিসি কর্মকর্তারা বলেন, মডেল সড়ক হিসেবে চালু করা সাইকেল লেনের মধ্য দিয়ে বদলে যাবে আগারগাঁও এলাকার চিত্র। সাইকেল লেন, ফুটপাত, সড়ক ঘেঁষে পার্কিং ব্যবস্থা ও সবুজায়নে আগারগাঁও হবে মডেল এরিয়া। অথচ এখন সেই লেন দখলের হিড়িক পড়েছে। সরকারি গাড়ি, বিভিন্ন যানবাহন, দোকানপাটে ভরে গেছে বহু কাঙ্ক্ষিত সাইকেল লেন।
সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে দেখা যায়, আগারগাঁও ৬০ ফিট রোডের মাথা থেকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সামনে দিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়, ডাক ভবনের সামনে দিয়ে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পর্যন্ত চালু করা হয়েছিল সাইকেল লেন। বর্তমানে সেই লেনে যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্রাক, লেগুনা, অ্যাম্বুলেন্স, রিকশা, চা, ফলের দোকানপাটে ভরে গেছে। লেনের ওপরই অবৈধভাবে বসেছে ওষুধের দোকান। এমনকি সাইকেল লেনের ওপরই ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই, বিশাল অংকের টাকা ব্যয় করে সাইকেল লেন তৈরি করেছিল উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের সামনের সাইকেল লেনে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি, প্রাইভেটকার, চায়ের দোকান, এমনকি ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফল। এসব যানবাহনের চালক ও দোকানদাররা জানেন না সাইকেলের লেনের কথা।
সিএনজিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি আসলে জানি না এখানে সাইকেল লেন ছিল কি না। ফাঁকা পেয়েছি তাই সিএনজি থামিয়ে একটু দাঁড়িয়ে আছি। অ্যাম্বুলেন্সচালক শিমুল বলেন, রোগী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং করেছি। আমরা অনেক আগে থেকেই যখনই রোগী নিয়ে আসি এখানে পার্কিং করি। সাইকেল লেন আছে তাতো জানি না। সবাই তো গাড়ি রাখে।
সাইকেল লেনের ওপরই ভ্যানে মাল্টা বিক্রি করেন সাইফুল ইসলাম। সাইকেল লেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জানি এখানে সাইকেলের লেন আছে। কিন্তু সাইকেল চলতে দেখি না। মাঝে মাঝে এখানে আসি মাল্টা বিক্রি করতে।
গুলশান থেকে পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে আসেন গাড়িচালক শান্ত। সাইকেল লেনের ওপরই গাড়ি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এটা জানি না। গাড়ি রাখার জায়গা নাই, তাই এখানে রাখছি। আরও অনেকেই রাখছে গাড়ি। এছাড়া বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উত্তরপাশের সড়কে সাইকেল লেনে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা।
আগারগাঁওয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সাইকেল লেন যখন চালু হয়েছিল তখন আমরা জেনেছি। প্রথম কয়েক মাস ফাঁকাই ছিল। কিন্তু এখন বিভিন্ন গাড়ি, দোকান সাইকেল লেনের ওপরে বসায় আর চালানো যায় না। তাই মূল সড়ক দিয়েই সাইকেল চালাতে হয়। শুধু তাই নয়, নিউরোসায়েন্সের সামনের সড়কে অস্থায়ীভাবে ওষুধের দোকানও চোখে পড়ে।
আগারগাঁওয়ে সাইকেল লেন থাকা এলাকায়ও কোথাও চোখে পড়েনি কোনো ট্রাফিক পুলিশ। ফলে অনায়াসেই যে কেউ সাইকেল লেনসহ সড়কে যেমন গাড়ি পার্কিং করতে পারছেন আবার বসাতে পারছেন দোকান।
সাইফুল আলম নামের এক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলে বলেন, সড়কে সাইকেল লেন দখল বলেন আর বাজার বলেন এসব দেখার দায়িত্ব কার? রাস্তায় লেন দখল করে যেসব দোকান বসিয়েছে ও গাড়ি পার্কিং করে রাখছে তা দেখার জন্য ট্রাফিক পুলিশ কোথায়?
আগারগাঁওয়ে সাইকেল লেনজুড়ে যানবাহন আর অবৈধ দোকানপাটে ভরে গেছে। তবে সাইকেল লেনের ব্যবহার কিছুটা চোখে পড়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে। সেখানে চালু হওয়া এক কিলোমিটার লেনের ওপরে তুলনামূলকভাবে কম সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়ি দেখা গেছে।
এ প্রকল্প চালুর শুরুতে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন পরিবেশবাদি ও সাইক্লিস্টরা। কিন্তু অবৈধ পার্কিং বিশেষ করে যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটে দখল হওয়া লেন সাইকেল চালানোর উপযোগিতা হারিয়েছে। ফলে অনেকেই এখন জানেন না সাইকেল লেন রয়েছে কি না।
বিডি সাইক্লিস্টের সদস্য রাফাত মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, সাইকেল লেন চালু করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখন আগারগাঁওয়ের ওই সড়কে দখলের জন্য আমরা সাইকেল চালাতে পারি না। আমরা এর জন্য প্রতিবাদও করেছি। যখন প্রতিবাদ করি তখন ২ থেকে ৩ দিনের জন্য ঠিক থাকে, এরপর আবার দখলে চলে যায়। তিনি বলেন, আমরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দেখি রিকশা ও সাইকেলের জন্য আলাদা লেন, রাস্তা রয়েছে। সেখানে মোটরসাইকেল যদি চলেও যায় সেনাবাহিনী তাদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। ফলে মূল সমস্যাটাই হলো পর্যবেক্ষণ না করা। পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরি। এর সঙ্গে দরকার সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতা।
আগারগাঁওয়ে সাইকেল লেন অবৈধ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমি মূলত এখানে যোগদান করেছি ২ থেকে ৩ দিন আগে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আমার কাছে নেই। বিস্তারিত জেনে হয়তো আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমানের সঙ্গে। ২০২০ সালে আগারগাঁও সাইকেল লেন চালুর বিষয়ে জানেন কি না এবং সরকারি-বেসরকারি গাড়ি পার্কিংসহ দোকান বসিয়ে অবৈধ দখলে ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে নারাজ।
সাইকেল লেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকদিন আগে আমরা বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। আমরা কড়া নির্দেশনা দিয়েছি যাতে কোনো অবস্থায়ই ছাড় না দেয় এবং এসব দোকান উচ্ছেদ করা হয়। রাজধানীতে সাইকেল লেন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা পুলিশকে চিঠি দিয়েছি। তাদেরও সহযোগিতা চাই। যারা এসব জায়গায় ভূমিকা রাখতে পারে সবার সহযোগিতা চাই। তিনি আরও বলেন, লোকজনকেও সচেতন হতে হবে। হকারদের মেরে আমরা কতটুকু সামলাতে পারবো, এটাতেও সমস্যা। এজন্য দোকানগুলোই ট্রাকে করে উঠিয়ে নিয়ে আসা দরকার।