ভোটের হিসাবে হবিগঞ্জ-৩ আসনে এগিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ২০০১ থেকে চারবার এই আসনে জয়ী হয়েছে নৌকা। এর মধ্যে উপ-নির্বাচনে বিএনপি জয় পেলেও নানা করণে টানা ২৩ বছর কোণঠাসা। সাবেক পৌর মেয়র বিএনপির গউছের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগে বলা চলে একক আধিপত্য এমপি আবু জাহিরের। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ।
স্থানীয়রা বলছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির হাতে চলে যাবে এই আসন।’ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘এটা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করবে।’ তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট আবু জাহির বলছেন, ‘আওয়ামী পরিবার ঐক্যবদ্ধ আছি। দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ নামে খ্যাত হবিগঞ্জ ২০০১ সালেও চারটি আসন আওয়ামী লীগকে দিয়েছে। এখনও এই ধারা অব্যাহত আছে, আগামী দিনেও থাকবে।’
হবিগঞ্জ-৩ আসনের বিভিন্ন এলাকা (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ নিয়ে ২৪১তম আসন) ঘুরে দেখা যায়, এলাকাজুড়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি আবু জাহিরের অবস্থান। স্কুল, কলেজ, পুল, কালভার্ট ও সড়ক, এমনকি মসজিদেও আবু জাহিরের নামফলক। কোথাও তিনি ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেছেন, কোথাও করেছেন উদ্বোধন। বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুনেও বর্তমান এমপির সরব উপস্থিতি।
এলাকার লোকজনও বলছেন, সবকিছুতেই এমপির আধিপত্য। উপজেলা প্রশাসন, থানাসহ সব অফিস এমপির ইশারায় চলে। এখানে অন্য কারও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
তবে কয়েকটি জায়গায় সাবেক পৌর মেয়র জি কে গউছের নামও দেখা গেছে। তিনি মেয়র থাকতে সেসব উন্নয়নকাজ করেছেন। যদিও এখন তিনিই এই আসনে বিএনপির প্রার্থী।
চায়ের দোকানের আড্ডায় লোকজন বলছে, এখানকার বিএনপি প্রার্থী জি কে গউছ মেয়র থাকাকালে শহরের সব উন্নয়ন হয়েছে। এছাড়াও এই সরকারের আমলে হামলা-মামলার কারণেও জনপ্রিয় তিনি। মানুষের সহানুভূতি আছে তার জন্য।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার অবস্থান কেমন? প্রশ্নের জবাবে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী আবুল হাশেম মোল্লা মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করবে।’
দলের অভ্যন্তরে কোন্দল বা নেতাদের দূরত্ব আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের নেতাদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে। তবে এগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ নানান বিষয় নিয়ে। জাতীয় নির্বাচনে সবাই এক হয়ে যাবে।’
সদরের ধুলিয়াখালের ব্যবসায়ী মতিউর রহমান খান চায়ের আড্ডায় গল্পের ছলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের এলাকা হলে কী হবে! ইলেকশন ঠিকঠাক হলে জি কে গউছ ৯২ শতাংশ ভোট পাবেন। আবু জাহির পাবেন ৮ শতাংশ।’
কারণ জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা কমে গেছে, নেতাদের ওপর নির্ভরশীল সবাই। আর নেতারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ, কেউ সুযোগই পায় না।’
এসব মানতে নারাজ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট আবু জাহির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় সরকারের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে আমি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, যেগুলো এরই মধ্যে বাস্তবায়নও করেছি। নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছি।’
‘বাংলাদেশের ৩১তম মেডিকেল কলেজ হিসেবে ‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ’ হবিগঞ্জে করেছি। দুটি ইউনিয়ন শায়েস্তাগঞ্জ ও নুরপুরকে ভেঙে তিনটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা করেছি। পরে আবার এগুলোর সমন্বয়ে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা করেছি। বাংলাদেশে এ নজির আছে বলে আমার জানা নেই।’
এমপি বলেন, ‘বৃন্দাবন সরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালু করেছি। প্রায় ১২টি নতুন কলেজ করেছি। ১৪টি নতুন উচ্চ বিদ্যালয় করেছি। এর বাইরে আধুনিক স্টেডিয়াম করেছি। সব বিভাগে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগেই ৭ম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হবিগঞ্জে করেছি। হবিগঞ্জের লাখাইয়ের বড়ভদ্র নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করে হবিগঞ্জ-ঢাকার দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার কমিয়েছি। ১৮ ফুটের আঞ্চলিক মহাসড়কও করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে হাওর আছে। হাওর থেকে মিঠাপানির মাছ সারাদেশে এবং বিদেশে রপ্তানি হয়। গ্যাস সারাদেশে যে পরিমাণ আছে, এর অর্ধেকের বেশি হবিগঞ্জের মাটির নিচে। এটা কেন্দ্র করে আমরা বিবিয়ানা-১, ২, ৩ শাহজিবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। প্রাকৃতিক গ্যাসকেন্দ্র করে হবিগঞ্জে শিল্পাঞ্চল ভরপুর হয়েছে। বেসরকারি শিল্প মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামের পরই শিল্পাঞ্চল খ্যাত হবিগঞ্জ।’
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী দিনেও এই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। মানুষ এখন আবার নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রীব। মানুষ কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখে। নৌকায় ভোট দিলে এখন যে আঞ্চলিক মহাসড়ক ১৮ ফুট করেছি, সেটি ৪০ ফুটে উন্নীত করবো। আমরা তৃণমূল থেকে দলকে সুসংগঠিত করেছি। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজলা আওয়ামী লীগের কমিটি করেছি।’ যোগ করে সংসদ সদস্য আবু জাহির।
অন্যদিকে বিএনপির জি কে গউছ নির্বাচনী ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আপাতত কেউ নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমি তো মাঠের কর্মী, পৌরসভার তিনবার মেয়র ছিলাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। দেশে যদি নিরপেক্ষ সরকার হয় তখন নির্বাচন ভাবনার মধ্যে আসবে। যেহেতু গত পার্লামেন্ট ইলেকশন করেছি সদরে, এটা তো কোনো নির্বাচন ছিল না, এটা ছিল নির্বাচনের নামে একটা প্রহসন। নির্বাচন নিয়ে এখন কোনো কথা বলতে চাই না।’
গউছ নির্বাচন নিয়ে চিন্তা না করলেও আগামীতে এ আসনে দলের মনোনয়ন নিয়ে ভাবছে অনেকে। বিএনপির সূত্র বলছে, গউছের পাশাপাশি জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এনামুল হক সেলিম এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. আহমুদুর রহমান আবদাল আগামীতে এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ বিষয়ে কথা হলে অ্যাডভোকেট মো. এনামুল হক সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গতবার মনোনয়ন চেয়েছিলাম। আমাকে প্রাথমিক চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমার আসনে গতবার আমি এবং জি কে গউছ ছিলাম মনোনয়নপ্রত্যাশী।’
তিনি বলেন, মূলত এটা বিএনপির আসন, এখন আমরা সারভাইভ করতে পারছি না। আমি বৃন্দাবন কলেজের জিএস ছিলাম, সবশেষ ছিলাম জেলা বিএনপির নির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক। গউছ সাহেব আমার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু উনি নির্বাচিত না। কেন্দ্র তাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। সে বিবেচনায় মনে করতে পারি ভোটের রাজনীতিতে আমি এগিয়ে। আর এখানে আমি বা জি কে গউছ এগুলো কোনো ফ্যাক্টর নয়। বাংলাদেশের মানুষ যদি ভোট দিতে পারে তাহলে প্রার্থী যেই হোক ধানের শীষ জয়লাভ করবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৬ হাজার ৫৯৩। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৯৯ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৪। গত একাদশ (২০১৮ সালে) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের আবু জাহির ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৩ ভোট এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জি কে গউস ৬৮ হাজার ৭৮ ভোট পান।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আবু জাহির ৯৮ হাজার ১৫৫ ভোট পান। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির আতিকুর রহমান। তিনি লাঙল প্রতীকে পান ২০ হাজার ৮৩৭ ভোট।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭০ শতাংশ এবং বিএনপি ২৭ শতাংশ ভোট পায়। ২০০১ এ আওয়ামী লীগ পায় ৪৭ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৯ শতাংশ।
ভোটের হিসাবে এখানে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান আছে। তবে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিল নানা সময়।